শিরোনাম :

  • মঙ্গলবার, ৮ জুলাই, ২০২৫

সাউথ এশিয়ান মনিটরের প্রতিবেদন

অস্তিত্বের সংকটে বাংলাদেশের গণমাধ্যম

নিউজ ডেস্ক |

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গভীর সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। টেলিভিশন, সংবাদপত্র বা অনলাইন–কেউই এ থেকে বাদ নেই। তবে সবচেয়ে বেশি সঙ্কট ছাপা পত্রিকা বা সংবাদপত্রে।

ছাপা পত্রিকার প্রচার সংখ্যা দিনে দিনে কমছে, কমছে বিজ্ঞাপণ। এতে করে কমে যাচ্ছে আয়। বড় কাগজগুলো কলেবর ছোট করে টিকে থাকলেও ছোট কাগজগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেকে প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে সিলেটসহ মফস্বলের অনেক কাগজ এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকায় মানবজমিন, দিনকাল, সংগ্রাম, আলোকিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশের খবর, জনতা, সময়ের আলো, ইন্ডিপেনডেন্টসহ বেশকয়েকটি দৈনিকের মুদ্রণ সংস্করণ স্থগিত করা হয়েছে। কবে আবার চালু হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। 

সংবাদপত্রগুলোর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে বিশেষ প্রণোদনা চেয়েছেন সম্পাদকরা। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার কয়েকজন সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বাসভবনে দেখা করে বিষয়টি তুলে ধরেন।

সম্পাদকেরা বলছেন, কভিড-১৯ ভাইরাসটি সারা পৃথিবীতে যে মহামারী ডেকে এনেছে, সেই ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশ সাধারণ ছুটি দফায় দফায় বাড়িয়ে ২৫ এপ্রিল করা হয়েছে। এই ছুটি আরো বাড়তে পারে। শিল্প কারখানাগুলো কার্যত বন্ধ। এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সংবাদপত্র শিল্পও এর বাইরে নয়। পত্রিকার কাটতি কমেছে। বিজ্ঞাপনও সীমিত হয়ে এসেছে। একই অবস্থা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর। তাই অন্তত আগামী পাঁচ মাসের জন্য গণমাধ্যমের সহায়তার জন্য সরকারের বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যেহেতু সংবাদপত্রও একটি শিল্প। করোনায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সংবাদপত্র শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংবাদপত্র শিল্পের জন্য সরকারের কাছে আমরা বিশেষ আর্থিক প্রণোদনার চেয়েছি। তথ্যমন্ত্রী আমাদের কথা শুনেছেন।’

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও একাত্তর টিভির এডিটর ইন চিফ মোজাম্মেল বাবু, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ডিবিসি চ্যানেলের সত্ত্বাধিকারী ইকবাল সোবহান চৌধুরী, দৈনিক সমকালের সত্ত্বাধিকারী এ কে আজাদসহ অন্যরা। 

এই বৈঠকের পর গত ৪ এপ্রিল সাংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন (নোয়াব)-এর সভাপতি একে আজাদ একটি চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। চিঠিতে তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত এজেন্ট, হকার, প্রেস কর্মী, পরিবহন কর্মী, বাইন্ডার, মেইল পিয়নদের জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন।

এ কে আজাদ বলেন, দেশে এজেন্ট ও হকার আছে ২০ হাজার ৩২০ জন, বাইন্ডার ও মেইল পিয়ন আছে ৮০৬ জন এবং পরিবহন কর্মী আছে ৮৫২ জন। করোনার কারণে এসব লোকজনের পেশা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এ জন্য তারা এসব লোকদের জন্য প্রণোদনা দাবি করেছেন।

সম্পাদকেরা মনে করছেন, এমনিতেই সংবাদপত্র ঝুকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থা কতদিন চলবে তা কেউ বলতে পারছেন না। এই অবস্থায় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন যদি অন্য পেশায় চলে যান বা বর্তমান পেশা ছেড়ে দেন তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও সংবাদপত্র শিল্প ঝুঁকমুক্ত হবে না। সে কারণে এদের টিকিয়ে রাখতে মরিয়া তাঁরা।

এরইমধ্যে অনেক পত্রিকা ও টিভিতে লোকবল ছাঁটাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। কয়েকমাস আগেও প্রথম আলো’র মতো অর্থনৈতিকভাবে ভাল অবস্থান থাকা পত্রিকা থেকেও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শাখার বেশ কয়েকজনকে ছাঁটাই করেছে।

দেশে সংবাদপত্র এমনিতেই সংকটে রয়েছে। নানামুখী চাপের কাছে সমঝোতা করে চলার কারণে সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। তাছাড়া কোন ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই মানুষ এখন ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে তা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করে পরদিন সেই সংবাদ পড়ার আগ্রহ থাকছে না। এতে সংবাদমাধ্যমের প্রচার সংখ্যায় টান পড়ছে। এই অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে। প্রতি বছরই ৬ শতাংশ হারে ছাপা সংবাদপত্রের পাঠক কমছে। দেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলোর প্রচার সংখ্যাও এক লাখের উপরে কমে গেছে। একইহারে অন্যসব কাগজের প্রচার সংখ্যাও কমেছে। স্বাভাবিক নিয়মে ধরা হয় দেশে ছাপা সংবাদপত্রের মোট পাঠক ১০–১২ লাখ। এখন হিসাব করলে এ সংখ্যা অনেক কম হবে বলেই সবার ধারণা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে সঙ্কটে থাকা সব ছাপা পত্রিকার প্রচার সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। একই সঙ্গে কমেছে বিজ্ঞাপণও। ফলে ব্যবসা ঠিকে রাখতে সব ছাপা পত্রিকা পাতার সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। দেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলোর এখন মাত্র ১২ পৃষ্টা ছাপা হচ্ছে। ৮ পৃষ্ঠায় নামিয়ে এনেছে নয়া দিগন্ত, ভোরের কাগজ, সংবাদ, ইনকিলাবসহ আরো অনেকে। কালের কণ্ঠ ও সমকাল ১৬ পৃষ্ঠা ছাপলেও কোনোভাবে টিকে থাকার মতো করে চলছে পত্রিকাগুলো।

পত্রিকা বিতরণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি ছুটির কারণে পত্রিকা বাড়ি বাড়ি পৌছে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। করোনা ছড়ানোর ভয়ে অনেক পাঠক ছাপা পত্রিকা হাতে ধরছেন না। অনেক বাড়িতে হকার ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজধানীর ডিওএইচএসসহ বেশ কিছু এলাকায় হকার প্রবেশ নিষিদ্ধ। আবার অনেক শহরে পত্রিকা বিতরণে বাধা দিচ্ছে পুলিশ। এতে করে ছাপা পত্রিকা ফেরত আসছে। 

সংবাদপত্রে সংকটের আরেকটি কারণ বিজ্ঞাপণ। সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকা বিক্রি না হওয়ায় মওকা পেয়েছেন বিজ্ঞাপণদাতারা। তারা বিজ্ঞাপণ দিচ্ছেন না। পত্রিকার পাতা প্রায় খালিই থাকছে। বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের বাজার টাকার অংকে কতটা বড় সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন হিসেব নেই। তবে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বলছে এ বাজার প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এই বাজারের বড় অংশ ধরে রেখেছিল টেলিভিশন। গত দশ বছর ধরে বিজ্ঞাপনের বাজারে টেলিভিশনের আধিপত্য বজায় থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুগল, ইউটিউব এবং ফেসবুক তাতে ভাগ বসিয়েছে। গত বছর এই প্রচার মাধ্যমে পকেটে ৯০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপণ চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন অনেক বিজ্ঞাপন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে এবং পরে টেলিভিশন প্রচার হয়। ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের ফিডব্যাক দেখে ক্লায়েন্ট সিদ্ধান্ত নেয় সে বিজ্ঞাপন কতবার কোন মিডিয়াতে প্রচার হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানি এরই মধ্যে বিজ্ঞাপনের জন্য ডিজিটাল বিভাগ খুলেছে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় খাত টেলিকম। এই খাতের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবছর তাদের সর্বমোট বিজ্ঞাপন বাজেটের ৭০ শতাংশ এখন ডিজিটাল খাতে ব্যয় হচ্ছে। ভোগ্যপণ্য সামগ্রী প্রস্তুতকারী কিংবা অন্যান্য খাতের কোপানীগুলো এখন ডিজিটাল খাতে বিজ্ঞাপনের জন্য ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করছে।

তবে আগামী তিন বছরের মধ্যে বিজ্ঞাপন বাজারের ২৫ শতাংশ ডিজিটাল খাত বা গুগল ও ফেসবুকে যাবে বলে তারা ধারণা করছেন। ইউটিউবেও বিজ্ঞাপনের হার বাড়ছে। ইন্টারনেট-ভিত্তিক যেসব ব্যবসা রয়েছে সেগুলো বিজ্ঞাপনের জন্য ইন্টারনেট মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছে।

বাংলাদেশে ডিজাটল ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, ডিজিটাল বিজ্ঞাপণ বাড়লেও বাংলাদেশের অনলাইন পোর্টালগুলো খুব বেশি লাভ করতে পারছে না। এর কারণ, হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল শুধু মানুষের আস্থা পেয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ অনলাইন এখনও সেভাবে আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এতে করে বেশিরভাগ অনলাইন পোর্টাল অর্থ সংকটে রয়েছে। প্রথম আলোর মতো বড় বড় পোর্টাল এখাতে বিপুল বিনিয়োগ করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। 

তবে প্রথম আলোর একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অনলাইন থেকে যে আয় আসছে তা দিয়ে ছাপা পত্রিকার ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সংকট থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে তা কাটিয়ে উঠে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ছাপা পত্রিকা আর আদৌ লাভের মুখ দেখতে পারবে কি না, সে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

সূত্রঃ সাউথ এশিয়ান মনিটর