আইটিডি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৭ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন
দায়িত্বের প্রশ্নে সাংবাদিকরা আপসহীন
হাসান ইমাম ♦
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের (আরএসএফ) করা সূচকে বাংলাদেশ ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের ১৫০তম অবস্থান থেকে এবার আরও এক ধাপ পিছিয়েছে তো বটেই, সেনানিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক মিয়ানমারও বাংলাদেশের ওপরে আছে। উপরন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ৯টি দেশের তলানিতে ঠেকেছে বাংলাদেশের অবস্থান।
আরএসএফ বলছে, বাংলাদেশে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এক না-পছন্দ সংবাদে রুষ্ট হয়ে সংশ্নিষ্ট সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেওয়ার যে প্রবণতা আমরা দেখছি, আরএসএফ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণে তা নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখছে। গত সপ্তাহেই ত্রাণ চুরি সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের ঘটনায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী ও জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারসহ চার সংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা।
বিশ্বব্যাপী রেওয়াজ হলো প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্যগত ভুল থাকলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি প্রতিবাদ জানাবেন। সংশ্নিষ্ট সংবাদমাধ্যম তা আমলে নিয়ে প্রকাশ করবে। যদি তা না করে তাহলে প্রেস কাউন্সিলে যাওয়ার সুযোগ আছে। দেওয়া যেতে পারে আইনি নোটিশও। সেসব পথ না মাড়িয়ে সরাসরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঢুকে দেওয়াকেই ঠাকুরগাঁওয়ের ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতা সহজ ও অব্যর্থ মনে করেছেন। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘মাজেজা’ তিনি অবগত। চাইলেই সংবাদমাধ্যমের ওপর যে কারও চড়াও হওয়ার এই বন্দোবস্ত যে অবারিত! আর রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে এর সুযোগ নেওয়া তার নাগরিক দায়িত্ব, তিনি এর হকদারও বটে।
অথচ আগের অন্য অনেক ঘটনার মতো পাক্ষিক ম্যাগাজিন পক্ষকাল-এর সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলের ‘গুম’ নিয়ে রাষ্ট্রের কাছে কোনো সদুত্তর নেই। একজন জলজ্যান্ত মানুষ মুহূর্তে ‘নাই’ হয়ে যান, অথচ কর্তৃপক্ষযেন নিদ্রায়। বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুর রহমানকে রীতিমতো ‘কমান্ডো’ কায়দায় গ্রেপ্তার ও দণ্ড দেওয়ার ঘটনায় তাই শুকরিয়া আদায় জরুরি হয়ে পড়ে! কেননা, তার খোঁজ তো আছে অন্তত, আপডেটহীন ‘নিখোঁজ সংবাদ’ হননি তিনি। যদিও পরে আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছেন সংবাদের এই মানুষটি।
এভাবে একের পর এক সংবাদের মানুষকে ‘শায়েস্তা’ করার নানা ঘটনার উদাহরণ টানা যায়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বিচারে গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সূচকে ১৪১ দেশের মধ্যে ১২৩তম অবস্থানে বাংলাদেশ।
এই বৈশ্বিক মহামারির সময়েই ত্রাণ নিয়ে নয়ছয়ের খবর প্রকাশ করায় দেশব্যাপী কত সংবাদকর্মীর ওপর ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ‘ক্ষমতা’ দেখিয়েছেন, তা কর গুনে শেষ হয় না। অথচ এসবের প্রতিকার পাওয়ার উদাহরণ শূন্য। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করার ঘটনারও কোনো সুরাহা এখনও হয়নি।
অর্থাৎ করোনা আক্রান্ত সময়ের আগে থেকেই গণমাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন ‘ভাইরাসে’র আক্রমণে পর্যদুস্ত। গলাব্যথা তার পুরোনো ব্যামো। এর সঙ্গে করোনা সংক্রমণের উপসর্গের মিল থাকলেও সম্পর্ক নেই কোনো।
নানা ছুতানাতায়, কত না ফন্দিফিকিরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে রাষ্ট্রযন্ত্র যেন সর্বদা সক্রিয়। জব্দ করতেই যেন একের পর এক প্রণীত হয় জবরদস্ত আইন। আছে ডিক্লারেশন বা অনুমোদন বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘটনাও। অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতার কারণেও কোনো কোনো গণমাধ্যম মুখ থুবড়ে পড়ে বৈকি। এমন পরিস্থিতিও কারও জন্যই ভালো হতে পারে না। আবার সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাত তো রয়েছেই। যেমন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে তেমনই বিরোধী দলের পক্ষেও। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বিরোধী দলের পক্ষের সংবাদমাধ্যম অবশ্য কমে এসেছে বা রং বদলিয়েছে। তবু মোটা দাগে গণমাধ্যম যে আছে গণমাধ্যমের জায়গাতেই, তা এখনও বুক ফুলিয়ে বলা যায়।
এই মারণ-মহামারির সময়ে সবাই যখন ঘরবন্দি, সাংবাদিকরা কিন্তু তখন রাজপথে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা অন্যদের ঝুঁকিমুক্ত রাখতে অবিরাম জুগিয়ে যাচ্ছেন তথ্য, সঠিক তথ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমায় গুজব ও ঘটনা যখন প্রায় ‘পার্থক্যহীন’, তখন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের শেষ ভরসার জায়গাটি সংবাদমাধ্যমই- এই করোনাকালে সে কথাটি নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেল। দেশের মানুষ মায় বিশ্ববাসী আরেক দফায় এটাও দেখতে পাচ্ছে, কোনো প্রতিদানের আশায় নয়, দায়িত্বের প্রশ্নে সংবাদকর্মীরা আপসহীন।
সাংবাদিক
hello.hasanimam@gmail.com