শিরোনাম :

  • মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

ব্ল্যাক ফোর টুয়েন্টি, দিগন্ত টিভি ও ইনুদের সাময়িক তত্ত্ব

এম আবদুল্লাহ

২০১৩ সালের ৬ মে ভোররাত। কয়েক সহকর্মীসহ আমি তখন কারওয়ান বাজার বিএসইসি ভবনের ১১তলায় বসে ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখে টিভি পর্দায় দৃষ্টি রেখেছিলাম। তখন আমার দেশ প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ হলেও ই-পেপার ও অনলাইন চালু ছিল। চ্যানেল অদল বদল করে শাপলা চত্বরের পরিস্থিতিতে নজর রাখছিলাম। ৪টা ২০ মিনিটের দিকে হঠাৎ দেখি দিগন্ত টেলিভিশনের পর্দা কালো হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম দিগন্ত টিভি পরিবারে অন্ধকার নেমে এসেছে।

প্রায় একই সময় ইসলামিক টিভির পর্দাও নিমিষে কৃষ্ণ রূপ নেয় । সেই কালো পর্দাটা সাত বছর পরও কালোই আছে। পর্দার সেই গাঢ় কালো রঙ চ্যানেল দুটির সহস্রাধিক কর্মীর জীবনে যে অমাবস্যা রাতের আঁধার নামিয়েছে তা এখনো কাটেনি। অমাবস্যা দীর্ঘায়িত হয় কত দিন, কত বছর? ২৫৫৫ দিনেও অমাবস্যার রাত শেষে ভোরের দেখা মিলছে না। বরং ঘনকালো অন্ধকার ক্রমেই গ্রাস করে চলেছে দেশের পুরো গণমাধ্যমকে। হয়তো অন্যভাব, ধীরলয়ে।

কি ঘটেছিলো সে দিন? কিভাবে বন্ধ করা হয়েছিল দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি । নিজের মত করে তা বর্ণনা না করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনটি তুলে ধরা যাক। ৬ মে বিবিসি অনলাইনে ‘দুটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করেছে তা এ রকম-

“বাংলাদেশে হেফাজত ইসলামের অবরোধ কর্মসূচি সম্প্রচারকে কেন্দ্র করে দিগন্ত টিভি এবং ইসলামিক টিভি নামে দুটি বেসরকারি টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করা দেয়া হয়েছে রোববার গভীর রাতে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, সম্প্রচার চুক্তি লংঘন ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টির কারণেই এ ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা।

ঢাকা থেকে রাকিব হাসনাত জানাচ্ছেন, সোমবার ভোররাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শাপলা চত্বর এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের হটিয়ে দেবার জন্য অভিযান শুরুর পরই এ দুটি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়।

তথ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেন, এটি সাময়িক পদক্ষেপ এবং এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

তবে ইসলামিক টিভির বার্তা সম্পাদক সাদ বিন রাব্বি সম্প্রচার নীতিমালা লংঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তারা নিরপেক্ষভাবেই সংবাদ প্রচার করছিলেন।

দিগন্ত টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক জিয়াউল কবির বলেন, ভোরবেলা কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসে সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত জানান এবং কিছু যন্ত্রপাতি জব্দ করে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তারা সম্প্রচার বন্ধের কোন সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেন নি, শুধু উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কথা বলেন।

তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, চ্যানেলেগুলোর ব্যাপারে আনা অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে, এবং এ ব্যাপারে চ্যানেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যও শোনা হবে।”

পরদিন ৭ মে বিভিন্ন সংবাদপত্রেে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানানো হয়-

“সোমবার ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পুরানা পল্টনের ১৬৬, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণীর আল-রাজী কমপ্লেক্স দিগন্ত টেলিভিশনের অফিসে গিয়ে এর সম্পচার বন্ধ করে দেন বিটিআরসি’র কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দিগন্ত টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক জিয়াউল কবীর সুমন এ তথ্য জানান। তিনি জানান, রাত ৪টা ২৪ মিনিটের দিকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী লোকজন এসে পিসিআর-এ (মাস্টার কন্ট্রোল রুমে) ঢুকে সুইচ বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয়ার পর কিছু যন্ত্রপাতিও জব্দ করে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে বিটিআরসি’র কর্মকর্তারাও ছিলেন।

তবে কী কারণে এর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তা তারা দিগন্ত কর্তৃপক্ষকে জানায়নি। তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সূত্র বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

তার আগে রাত ২টার দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইসলামিক টিভির কার্যালয়ে গিয়ে সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সম্প্রচার কক্ষে তালা লাগিয়ে দেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শামস এস্কেন্দার। তিনি বলেন, রাত আড়াইটা থেকে তাদের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বিটিআরসির কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সোমবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ ও দাঙ্গা লাগানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় টেলিভিশন দুটির সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এর আগে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় তালা দিয়ে প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমান সরকারের আমলেই বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”

রিপোর্টগুলো পড়লে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, নির্দিষ্ট কারণ না দেখিয়ে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার আকস্মিকভাবে বন্ধ করার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের প্রতি এটা বড় আঘাতও।

আদালতের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশে দৈনিক আমার দেশ-এর ছাপাখানায় তালা ঝোলানো হয় একই বছরের ১১ এপ্রিল । সেই তালাও ৭ বছরে খোলা যায়নি। আইনী প্রতিকার পাওয়ার জন্য আমার দেশ কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েও ব্যর্থ হয়েছে। আমার দেশ এর প্রেস খোলার আদেশ চেয়ে করা রীট শুনানীই করতে দেয়া হচ্ছে না।

সরকার একদিকে দাবি করছে যে তারা বাকস্বাধীনতা ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল, অন্যদিকে একের পর এক বিরোধী মনোভাবাপন্ন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দমনমূলক আচরণ করছে।গণমাধ্যম এবং সচেতন সব মহলের উচিত ছিলো সরকারের এই অগণতান্ত্রিক ও গণমাধ্যমবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দল ও মতের ভেদাভেদ ভুলে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। কারণ, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা যায় না।

গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির আরও অনেক পথ আছে । টিভি চ্যানেল দুটি যা লাইভ প্রচার করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচার করা চ্যানেল সদর্পে চালু আছে। ফলে কেবল ‘হেফাজত ম্যাসাকার’ লাইভ করার জন্য বন্ধ করা হয়েছে তা মেনে নেয়া কঠিন। যদি ধরেও নেই যে ওই দুটি টিভি চ্যানেল প্রচলিত আইন বা নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে, তাহলেও তাদের কণ্ঠ এভাবে স্তব্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। আজকের যুগে কথিত ‘মৌখিক আদেশে’ মধ্যরাতে সম্প্রচারের যন্ত্রপাতি জব্দ করার ঘটনা অভাবনীয়।

আনলাকি টুয়েন্টি-থার্টিনের (২০১৩) ব্ল্যাক ফোর টুয়েন্টিতে (৪ টা ২০মিনিট) সাময়িক অ্যাকশনে মঞ্চের ভিলেন ছিলেন ইনু সাহেব। সচিবালয়ে সিংহাসন হারিয়ে এখন তিনি রাস্তায় ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করছেন কিনা জানিনা। যদিও তাঁর উৎসাহী কালো থাবায় বন্ধ টিভি ও সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা ৭ বছরেও তাদের কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। অর্থকষ্টে ধুঁকছেন। তবুও বোধ করি সামাজিক মান-মর্যাদায়, নৈতিক শক্তির মানদণ্ডে ইনুদের চেয়ে ভালোই আছেন মজলুম সংবাদকর্মীরা।

লেখকঃ মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে