নজরুলকে ঘিরে চার প্রশ্নের উত্তর কোনো দিন পাওয়া যাবে কি?

কাজী আলিম-উজ-জামান ।।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছিল দরিদ্র পরিবারে, এমন ধারণা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমেদ, যিনি ৬০ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি একজন দলিল লেখক ছিলেন। শেষ জীবনে এসে তিনি কিছুটা দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন, এটা সত্য। তবে নজরুলের পূর্বপুরুষ মোটেই দরিদ্র ছিলেন না। মোগল আমলে তাঁরা নবাবদের চাকুরে ছিলেন এবং স্থানীয়ভাবে বিচারকাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। চুরুলিয়ায় তাঁদের প্রচুর না হলেও যথেষ্ট কৃষিজমি ছিল।

নজরুল ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। আরবি-ফারসিসহ চারটি ভাষা জানা এই ফকির আহমেদের ছিল পাশা খেলার নেশা। পাশা খেলেই তিনি তাঁর ৪০ বিঘা কৃষিজমি হারিয়ে ছিলেন, এমন কথা প্রচলিত আছে। সুপুরুষ ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী, নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন উচ্চবংশজাত নারী। এ ঘরে চার সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলী হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। রানীগঞ্জের কয়লাখনিতে চাকরি নেন।

একসময় তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ৫০ বছর বয়সেই তাঁর মৃত্যু হয়। কাজী আলী হোসেন মক্তবে লেখাপড়া শেষ করে বাবার দলিল লেখকের পেশা বেছে নেন। এলাকার কৃষক-শ্রমিকদের হয়ে কাজ করতে গিয়ে একসময় স্থানীয় জমিদারদের রোষানলে পড়েন। ১৯৫১ সালে প্রকাশ্যে তাঁকে হত্যা করা হয়। নজরুলের আপন বোন উম্মে কুলসুম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এ ছাড়া তাঁর একটি সৎবোনও ছিল।

নজরুল-প্রমীলা দম্পতির ঘরে চারটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মোহাম্মদ মারা যায় খুব ছোট বয়সে। দ্বিতীয় সন্তান অরিন্দম খালেদ বুলবুলের মৃত্যু হয় মাত্র চার বছর বয়সে। এ সন্তানের মৃত্যুতে নজরুল একেবারেই মুষড়ে পড়েন। ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়’—গানটি বুলবুলকে নিয়েই লেখা। অপর দুই সন্তানের মধ্যে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ কেউই দীর্ঘায়ু পাননি। নামকরা বাচিকশিল্পী সব্যসাচীর মৃত্যু হয় মাত্র ৫০ বছর বয়সে। তাঁর স্ত্রীর নাম উমা কাজী। অনিরুদ্ধ—প্রখ্যাত গিটারবাদক—মারা যান মাত্র ৪২ বছর বয়সে। তাঁর স্ত্রী কল্যাণী কাজী।

সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধের জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁদের স্ত্রীরা দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। উমা ৮০ বছর ও কল্যাণী ৮৭ বছর বেঁচে ছিলেন। সব্যসাচী-উমা এবং অনিরুদ্ধ-কল্যাণী—উভয়েরই তিনটি করে সন্তান। নজরুল পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ বাংলাদেশের, কেউ ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।

রহস্যে মোড়া চার ঘটনা

মায়ের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক

প্রথম রহস্যাবৃত ঘটনা নিঃসন্দেহে মায়ের সঙ্গে নজরুলের তিক্ত সম্পর্ক। নজরুল কিশোর বয়সেই ঘর ছাড়েন। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে ৪১ নম্বর বাঙালি পল্টনে নাম দিয়ে করাচি যান। ফিরে এসে দিন দশেকের জন্য জন্মস্থান চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ ঘটে। কিন্তু কী নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল, তা কোনো গবেষক আজ পর্যন্ত খোলাসা করতে পারেননি। তবে ফকির আহমেদের মৃত্যু হলে অপূর্ব সুন্দরী জাহেদা খাতুনের সঙ্গে নজরুলের এক চাচার নিকাহ হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দসহ অনেক গবেষকই জাহেদা খাতুনের দ্বিতীয় বিয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম রহস্যাবৃত ঘটনা নিঃসন্দেহে মায়ের সঙ্গে নজরুলের তিক্ত সম্পর্ক। নজরুল কিশোর বয়সেই ঘর ছাড়েন। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে ৪১ নম্বর বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে করাচিতে যান। ফিরে এসে দিন দশেকের জন্য জন্মস্থান চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ ঘটে। কিন্তু কী নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল, তা কোনো গবেষক আজ পর্যন্ত খোলাসা করতে পারেননি।

অনেকেই মনে করেন, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নজরুল মেনে নিতে পারেননি। মা-ছেলের তিক্ততার এটাই প্রধান কারণ। পরবর্তী সময়ে নজরুলের ছন্নছাড়া জীবন, হিন্দু মেয়েকে বিয়ে—এ রকম নানা বিষয় মা-ছেলের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু জাহেদা খাতুন নানাভাবে চেষ্টা করেছেন ছেলের মুখদর্শনের। এমনকি নজরুল যখন কারাগারে, তখনো মা ছেলের কাছে গিয়েছেন। কিন্তু নজরুল দেখা দেননি। জাহেদা খাতুন যখন মৃত্যুশয্যায়, শেষবারের মতো ছেলেকে দেখার আকুতি জানিয়েছিলেন, কলকাতায় নজরুলের বাসায় গিয়েছিলেন কবির ভাই ও এক চাচা। তবু নজরুল মায়ের শয্যাপাশে যাননি।

কিন্তু নজরুল সারা জীবন মাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। মা ডেকেছেন বহু নারীকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দৌলতপুরের আলী আকবর খানের মেজ বোন এবং নার্গিসের খালা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলির মিসেস এম রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীসহ অনেকেই। এর মধ্যে বিরজা সুন্দরী নজরুলকে কারাগারে লেবুর রস পান করিয়ে অনশন ভাঙান।

শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকে অবশ্য মা না বলে মাসিমা ডাকতেন নজরুল। আর তিনি জামাতাকে ডাকতেন ‘নুরু’ বলে। নজরুল যখন এসব ‘নকল’ মায়েদের স্তুতি করছেন, তখনো তাঁর আসল মা বেঁচে ছিলেন।

নজরুল-নার্গিস সম্পর্ক

নজরুল ভালোবেসেছিলেন পঞ্চদশী নার্গিস আসার খানমকে। এর যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু নার্গিস কতটা ভালো বেসেছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বিচ্ছেদের পর আরও ১৬ বছর তিনি অবিবাহিতা ছিলেন। এ বিষয়ে দুজন বড় লেখক মুজফ্ফর আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন লিখেছেন, নজরুলের প্রতি নার্গিসের প্রেম–প্রেম ব্যাপারটা ছিল আসলে মামা আলী আকবর খানের নির্দেশে অভিনয়মাত্র। গোটা ব্যাপারটা ছিল আলী আকবর খানের পূর্বপরিকল্পিত এবং আলী আকবর খান ভাগনির মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নজরুলকে প্রায় গৃহবন্দী করে রেখে তাঁর পুস্তক ব্যবসায় পসার জমাতে চেয়েছিলেন। তবে এ মতই যে সর্বেসর্বা, তা এককথায় বলা যায় না। প্রসঙ্গত, নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের আক্দ হয়েছিল, বাসর হয়নি।

কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া ও নজরুল

১৯২০ সালে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় নজরুল ও তাঁর বন্ধু পার্টির সংগঠক মুজফ্ফর আহমদের সহকক্ষবাসী ও সহকর্মী ছিলেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে তিনি পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন। এ বিষয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘ভারত বিচিত্রা’২০০৪ সালের আগস্ট সংখ্যায় লিখেছেন, ‘এটা কি কমিউনিস্ট দর্শন বা রাজনীতির প্রতি অনাস্থা? অথবা কমিউনিস্ট পার্টি করলে যে নিশ্চিত রাজরোষ ও কারাবরণ কিংবা গ্রেপ্তার পরোয়ানা এড়িয়ে অনিশ্চিত কালজুড়ে আত্মগোপন করে থাকার মতো কষ্ট ভোগ থেকে মুক্ত থাকার উপায়? অথবা রাজনৈতিক যন্ত্রণা ও নিপীড়ন এড়িয়ে সদ্য বিবাহিত জীবনটাকে স্বাভাবিকভাবে অব্যাহত রাখার গোপন আকাঙ্ক্ষার পরিচয়? কিংবা একজন কবি যেহেতু সৃজনশীল প্রতিভা, প্রত্যক্ষ রাজনীতির পরিবর্তে ব্যাপক ও স্বাধীনভাবে জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনই এর প্রকৃত সাধনা হওয়া উচিত—এই সোন্দর্যতাত্ত্বিক উপলব্ধির ফল?’
তবে নজরুল যে একজন সাম্যবাদী ছিলেন, তা তার নানা লেখায়-কথায় স্পষ্ট। একধরনের সমাজতান্ত্রিক আদর্শে তাঁর বিশ্বাস ছিল, এটা বলা যায়। দুই পুত্র সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধের ডাক নাম সানি ও নিনি রেখেছিলেন দুই সমাজতান্ত্রিক নেতা চীনের সান ইয়াত-সেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনের নাম অনুসারে।

ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে বিতর্ক

নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ ও মৃত্যু ১৯৭৬ সালে। এই ৭৭ বছরের জীবনে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন ২৩ বছরের। ১৯১৯ সাল থেকে নজরুলের লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত নজরুল লেখালেখি করেছেন। বাকি ২৩–২৪ বছর তিনি শুধু শ্বাস নিয়েছেন আর কাগজ ছিঁড়েছেন!

নজরুলের চিকিৎসা নিয়ে সে সময় কম দৌড়াদৌড়ি হয়নি। যদিও যাঁদের কাছে বেশি প্রত্যাশা ছিল, সেই শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, ডা. বিধান চন্দ্র রায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিরা শুরুর দিকে ততটা চেষ্টা করেননি বলে বিভিন্ন সূত্র বলছে। তবে দেরিতে হলেও নজরুলকে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনায় পাঠানো হয়। তবু তাঁকে সুস্থ করা যায়নি। এ বিষয়ে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞদের প্রণীত সবশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তাতে এই রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ অনুপস্থিত।

প্রশ্ন হলো, নজরুলের জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল, অস্বাভাবিকতা ছিল, কিন্তু এমন রোগ কীভাবে তাঁর শরীরে বাসা বাঁধল? রোগ যেমন বলেকয়ে আসে না, এটা যেমন সত্য, তেমনি যেকোনো দুরারোগ্য ব্যাধির একটা কারণও থাকে, সেটাও সত্য। এটা কি এমন যে নজরুলের দেহে আগে থেকেই এমন কোনো রোগজীবাণু সংক্রমিত হয়েছিল কিংবা এমন কোনো রোগে তিনি সেখানে ভুগছিলেন, যার পরিণতি ছিল দুরারোগ্য ওই রোগ।

সম্ভবত, এই চার প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর কোনো দিন পাওয়া যাবে না। যাবে কি?

Print Friendly, PDF & Email