ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান বিশিষ্টজনের
বিদায় ২০১৯ স্বাগত ২০২০
বিশেষ প্রতিনিধি |
নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, আনন্দ-বেদনা আর স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বিদায় নিলো বছরের শেষ সূর্য। বুধবার (১ জানুয়ারি) ভোরে নতুন বছরে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে উঠবে নতুন সূর্য। সেই সূর্যের আলোয় ধুয়ে-মুছে যাবে সব অস্থিরতা, না-পাওয়ার গ্লানি। নতুন উদ্যমে দেশ ও সমাজ গড়ার কাজে নামবে প্রতিটি মানুষ। এই প্রত্যাশায় পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গোটা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে প্রস্তুত বাংলাদেশও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘটন-অঘটনে কেটেছে এক বছর। রাজনৈতিক মাঠে বিরোধী স্বর না থাকা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়া, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মতো ঘটনা কিংবা আবরারের মতো ‘শিবির সন্দেহে’ পিটিয়ে হত্যার ঘটনাগুলো নিয়ে অস্থির সময় কেটেছে। এছাড়া বছরের বড় একটা অংশজুড়ে ছিল গুজবের মধ্য দিয়ে কোনও একটি ঘটনা ঘটানোর সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা। কেবল গুজবের কারণে প্রাণ গেছে তরুণী মায়েরও। নতুন বছরকে বরণের মধ্য দিয়ে মানুষকে আরও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বছরজুড়ে নাগরিকের হয়রানির অন্যতম কারণ ছিল ডেঙ্গু। বছর শেষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় সরকারি হিসেবে ১৪৮। প্রকোপ এতটা বেড়ে যায় যে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ঢাকা শহরে ‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলেন, ডেঙ্গু সমস্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনও সমস্যা ছিল না। পর্যাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণসহ সতর্কীকরণ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতির মানসকিতা, প্রস্তুতি ও কৌশলের অভাব এবং যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে এডহকভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সুনির্দিষ্ট কৌশলের অভাবে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কোনও সমন্বিত পরিকল্পনা গুরুত্ব পায়নি।
‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অধিকারকর্মীরা। এসবের অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সরকারের জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ৩৬২ জন, যার ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে বা জিম্মায় থাকাকালীন।
বছরের শেষের দিকে আলোচনায় ছিল দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর কিছু নেতাকর্মীর দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়ানোর বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিযান চালানোর কথা বলেছিলেন সিনিয়র নেতাদের এক বৈঠকে। এরপর প্রথমে র্যাব ঢাকায় চারটি নামকরা ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনো বাণিজ্য বন্ধ করে এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কয়েকজনকে আটকও করে।
তবে এই অভিযানের সফলতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোনও অভিযান সফল করতে হলে টোটাল যে নেটওয়ার্ক, তার একটা অংশকে টার্গেট করে সফলতা পাওয়া সম্ভব না।
এছাড়া দেশজুড়ে বাজারে অভিযান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস, বড় চালান আসার খবর—কোনও কিছুই পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। ত্রিশ টাকার পেঁয়াজ তিনশ’ টাকা কেজিতে কিনতে হয়েছে দেশবাসীকে। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ, মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজ নষ্ট থাকাসহ নানা কারণ উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা। তবে এই ঘটনাকে সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে পুরো বছরেই নারীর ওপর অত্যাচার নিপীড়নের ঘটনা এসেছে। নিপীড়নের মাত্রাকে হতাশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে অধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেন, এতকিছুর পরেও এটি থামছে না, কারণ যারা নাগরিকের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে, তারা সেই দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যদি তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল না হয়, চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন যদি না হয়, তাহলে এরচেয়ে ভালো পরিস্থিতি হবে না। গণমাধ্যম স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সামনে আনায় আন্দোলন ও পরবর্তীতে বিচার পেয়েছে বলে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি আরও বলেন, নারীদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এ বছরে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। পরিবারের মধ্যে যে এগুলো বাড়ছে, সেটিও উদ্বেগের। ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে যারা মুখ খুলছিল, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক হেনস্তার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কারণ তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। ফলে মুখ খোলাটাও বন্ধ হয়েছে।
বিভিন্ন সময় আন্দোলন যারা করেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ করে থামানোর কারণে ভীতি বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ভিপির ওপর যে আক্রমণ, জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষকদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, সেটাও ভীষণ উদ্বেগের। রাজনীতিতে যারা আছেন, ক্ষমতায় যারা আছেন, সংসদে যারা আছেন, তারা যেন আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে করণীয় নির্ধারণ করেন।
অন্য বছরগুলোর মতোই কেটে গেছে ২০১৯, তবে মন্দের ভাগ বেশি ছিল উল্লেখ করে অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, যে মন্দটা আমরা দূরে রাখতে পারতাম, যে মন্দ থাকার কথা ছিল না, সেটি কীভাবে যেন রয়ে গেছে। মানুষের গরিব অবস্থার উত্তরণের পথ খোঁজা হচ্ছে। আমরা রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় সহপাঠীকে মেরে খেলা দেখতে যাওয়া, ব্যাংক লুট করে হাসতে হাসতে বাইরে যাওয়া, গুজব ছড়িয়ে এক তরুণী মাকে মেরে ফেলা, ফেসবুক হ্যাক করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা ছিল বছরজুড়ে। তবে আমরা তো এমন জাতি না, আমাদের অজান্তে সমস্যার পাহাড় হয়ে যাচ্ছে। বছরের শেষে এসে এই অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো খুব ভোগাচ্ছে। ‘পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোন বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই’, আমরা সেই প্রশ্ন তোলার সময় পেরিয়ে গেছে।
তবে বছর ভালো কেটেছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সরকার গঠন হয়েছে, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে কমিটি হলো। সরকার গঠন ও দল গঠনের বছর গেলো ২০১৯। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রগতি অব্যাহত আছে। সব মিলিয়ে দেশের জন্য বছরটি ভালোই ছিল, নেই কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা। এখানে জনবিচ্ছিন্ন কিছু দল, যারা দুর্নীতির কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে, তারা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করেছে। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যখন যা প্রয়োজন সেই পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বড় কোনও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি।
২০২০ আরও ভালো যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে, সারাদেশের মানুষ এর সুফল ভোগ করবে। প্রত্যাশিত এই সেতু হলে, দেশের মানুষের বড় প্রাপ্তি ঘটবে। পাশাপাশি বিভিন্ন অর্জন সফলভাবে এগিয়ে নিতে পারবো। সব মিলিয়ে ২০২০ সালে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে মাইলফলক হবে।
তবে ২০১৯ সালকে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার জন্য খারাপ একটি বছর বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদের নির্বাচন যেটি হয়েছিল সেটিকে ভালো নির্বাচন বলা যায় না, গণতন্ত্র থেকে সরে গেছে। গণতন্ত্র না থাকার কারণে সহনশীলতা কমে গেছে অস্থিরতা বেড়েছে। পুলিশ প্রশাসন সরকারবিরোধী মত-পথকে দমানোর জন্য সচেষ্ট থেকেছে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে রক্ষার কোনও দায়িত্ব তারা নেয়নি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র গতবছর দুর্বল হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা ভয়ঙ্কর লুটপাটের দিকে গিয়েছি। রাশেদ খান মেনন কয়দিন আগে বলেছেন লাখো ও হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিতর্কই বেড়েছে, অধিকার বিপন্ন হয়েছে। কৃষকরা তার উৎপাদিত দ্রব্যের ন্যায্যমূল্য পায়নি, বোরা উৎপাদনে যে খরচ সেটিও উঠে আসে না। যে কারণে গতবছর কৃষক তার ধানে আগুন দিয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে যদি দেখি, অধিকার আদায়ে শ্রমিক জীবনও দিয়েছে। সমগ্র বিষয়ে কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা লক্ষ করেছি। খালেদা জিয়াকে একটি মামলায় কেবল বন্দি করা হয়েছে তা নয়, তার প্রাপ্য জামিন দেওয়া হয়নি। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সংকট লক্ষ করছি, সব মিলিয়ে বছরটা ভালো, এটা বলার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।