করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে কবে?

হাবিবুর রহমান

বিশ্বের ৭০০ কোটিরও বেশি মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, কবে শেষ হবে এই করোনাভাইরাস মহামারি। আজ পর্যন্ত ৮২ হাজারের বেশি লোক মারা গেছেন, সংক্রমিত হয়েছেন ১৪ লাখের বেশি। দিন দিন বেড়েই চলছে এর মাত্রা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম ধরা পড়ে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। ভাবা হয়েছিল এটি চীনেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। কিন্তু দুই মাসের মধ্যেই এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে—ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ায়। 

এখন প্রশ্ন হলো এই ভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে কবে? আমরা যদি মহামারির শতাব্দীর ইতিহাসগুলো দেখি, তাহলে দেখব প্লেগ, গুটিবসন্ত, কলেরা ও ফ্লুতে কোটি কোটি লোক মারা গেছেন। শুধু এক প্লেগেই মারা গেছেন ৩৫ থেকে ৪৭ কোটি লোক। ইউরোপের ২০০ বছর লেগেছে তাদের জনসংখ্যা আগের সংখ্যায় ফিরিয়ে আনতে। 

প্রতিটি মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে যখন মানুষ জেনেছে এর প্রকৃত কারণ অথবা এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে অথবা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে। প্লেগের কারণ ছিল একটি ব্যাকটেরিয়া; সে সময় প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। ধারণা করা হয় সংক্রমণের পর প্লেগের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, যা পরবর্তী সংক্রমণ থেকে রেহাই দিয়েছে। গুটি বসন্তেও তেমনি অনেক মানুষ মারা গিয়েছে যত দিন না এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয়েছে। কলেরার টিকা এখন পাওয়া যায়, কিন্তু এটি দূর হয়েছে মূলত যখন জানা গেল এটি পানিবাহিত রোগ। লন্ডনের একজন ডাক্তার, জন স্নো, প্রথম আবিষ্কার করেন কলেরার মূল কারণ অবিশুদ্ধ পানির ব্যবহার। এখনো কলেরার সংক্রমণ দেখা যায় যেখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার কম, যেমন আফ্রিকায়। হাইতিতে কিছুদিন আগেও কলেরায় অনেক মানুষ মারা গেছেন। ফ্লুর  ক্ষেত্রে প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার এই মহামারি থেকে রেহাই দিয়েছে। প্রতিবছর ফ্লুর টিকা দিতে হয় যাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

করোনাভাইরাসও এক ধরনের ফ্লু ভাইরাস, কিন্তু এর ভয়াবহতা মারাত্মক, যা অন্য ফ্লুর মতো নয়। করোনাভাইরাস প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৩০ সালে, যা মূলত পশু-পাখিদের ক্ষেত্রে দেখা যেত। মানবদেহে প্রথম সংক্রমণ দেখা যায় ২০০৩ সালে, যা সার্স করোনাভাইরাস নামে পরিচিত। এটিও ছিল ভয়াবহ, সংক্রমিতদের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ৩০ শতাংশ। বর্তমানে কভিড-১৯ ভাইরাসটি সার্সের মতোই একটি ভাইরাস। এটি একটি একক মাত্রার এমআরএনএ ভাইরাস। এখন যেহেতু চিকিত্সাবিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে, বিজ্ঞানীরা খুব দ্রুততম সময়েই এই ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স বের করে এর টিকা আবিষ্কারের দিকে একধাপ এগিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ৫০টির মতো টিকা পরীক্ষাগারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। এর মাঝে আমরা একটি বা দুটি টিকা পেয়েই যাব, যা ১০০ শতাংশ কার্যকর হবে। কিন্তু এই কার্যকর টিকা হাতে পেতেও অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর পাশাপাশি কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের গবেষণা চলছে, যা হয়তো এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে।

কিছু ওষুধ যা আগে থেকেই অন্য অসুখে ব্যবহার হতো, তা এই ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কিছু সাফল্য দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক ওষুধ কম্পানি এই ওষুধগুলো বানায়। আমরা দেখছি অনেকেই এই ওষুধগুলো কিনে স্টক করছেন। কিন্তু এগুলো চিকিত্সকের যথাযথ পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত। দেখা যাবে যিনি সংক্রমিত, তিনি ওষুধটি পাচ্ছেন না। একই কথা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ক্ষেত্রে, অনেক ওষুধ কম্পানি এটি বানায়, এটিও অনেকেই কিনে স্টক করছেন। আমরা স্টক না করি, কারণ এগুলো সব সময় পাওয়া যাবে। এর পাশাপাশি আমাদের দেশে টিকা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। ইনসেপটা ভ্যাকসিন লি. এখন পর্যন্ত অনেক টিকা তৈরি করেছে, তার মাঝে কলেরা ভ্যাকসিন একটি। আশা করা যায়, টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি করা সম্ভব হবে।

তাহলে এটি অন্তত পরিষ্কার যে এই ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য আমাদের আরো এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল এটি যাদের একবার হবে তাদের ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা দেখছি দ্বিতীয়বারের মতোও সংক্রমণ হতে। তাই কার্যকর টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। আমরা যেহেতু এখন জানি এই সংক্রমণ কিভাবে ছড়ায়, তাই আমাদের নিজেদের সাবধানে থাকতে হবে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার অথবা সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধুতে হবে যখনই বাইরের কিছুর সংস্পর্শে আসা হয়। আর যতটুকু পারা যায় বাসায় থাকা। এটি যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেই ছড়ায়, তাই আমাদের উচিত আক্রান্ত ব্যক্তিদের  সুস্থ মানুষদের কাছ থেকে আলাদা করা। তাহলে হয়তো সংক্রমণের হার কমবে। চীনের উহানে যেমন করে লকডাউন করে তাদের দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেছে, তেমনি করেই আমাদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। 

তাই কার্যকর টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মূল লক্ষ হলো কঠোরভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা।

লেখক : ডিজিএম, মার্কেটিং, ইনসেপটা ভ্যাকসিন লি.

Print Friendly, PDF & Email