সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণ ও অকল্যাণ
প্রকৌশলী আবদুল হাফিজ খসরু: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (Social Media) আমাদের আধুনিক জীবনের এক নতুন বাস্তবতা। ইন্টারনেট ভিত্তিক এই ইলেক্ট্রনিক্স গণমাধ্যম ভার্চুয়াল যোগাযোগের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ভৌগলিক দূরত্ব পুরোপুরি দূর করে দিয়েছে। সুদূর প্রবাসের হাজার মাইল দূরের নিকটাত্মীয়ের সাথে সরাসরি ভিডিও কথোপকথন এখন প্রায় বিনা খরচে সবাই করছে। গ্রামের চায়ের দোকানে মানুষ তথ্যের জন্য এখন আর পত্রিকার পাতা ঘাটাঘাটি করে না। গণমাধ্যমে তথ্যের বিপণনে সাবেকি প্রথা বিলোপ সাধন করে তার বদলে এসেছে এন্ড্রয়েড ও আইফোন ভিত্তিক স্মার্টফোন। চারপাশ, দেশ-বিদেশে কী ঘটছে সেগুলো ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, গুগল সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তাৎক্ষণিকভাবে সচিত্র প্রতিবেদন পেয়ে যাচ্ছে সবাই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বলা যায় ব্যক্তিগত সম্প্রচার মাধ্যম। সাধারণ মানুষ চাইলেই মূল ধারার গণমাধ্যমে দ্রুততর সময়ে কোন কিছু প্রচার করতে পারেন না। বর্তমানে ফেসবুকের ভাইরাল ভিডিও ও ছবি দিন শেষে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায়ও স্থান পায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন এক মাধ্যম যেখানে চাইলেই যেকোন সময়ে নিজের অবস্থা, তথ্য, অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা প্রভৃতি অডিও-ভিডিও করে প্রকাশ করা যায়। এখানে নিজের বন্ধু-বান্ধব, সমাজ ও রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতে পারে ও তথ্যের আদান প্রদান করতে পারে। জনমত গঠন ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতেও বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। পড়াশোনা, সমাজসেবা, রক্তদান, সামাজিক ক্যাম্পেইন, সৃজনশীল কাজ এবং ব্যবসার জন্যও ফেসবুক ব্যবহার করছেন অনেকে। ফেসবুক ব্লগিংয়ের মাধ্যমে সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সামাজিক বিষয় নিয়ে আগে ব্যবহারকারীরা যা ব্লগ ওয়েবসাইটগুলোতে লিখতেন তা এখন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখছেন।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু এর কুপ্রভাব আমাদের জন্য অত্যন্ত আশংকার কারণ। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফেসবুক, টিকটক, ইন্সটাগ্রাম প্রভৃতির অপব্যবহার ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। ব্যক্তির মানসিক ও শারিরিক অসুস্থতা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এসব মিডিয়ার অপব্যবহারের মাধ্যমে। আমাদেরকে সোশাল মিডিয়ার কল্যাণকর ব্যবহার যেমন জানতে হবে তেমনি তার ক্ষতিকর বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণকর দিক
- নিজের ইচ্ছা ও মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা
- নিজের ধর্মীয় আদর্শ বাধাহীনভাবে প্রচার করা
- সহজেই অডিও-ভিডিও কলের মাধ্যমে কথোপকথন করা
- বিপদ বা দুর্যোগের খবর সহজ প্রাপ্তি
- সাহায্য বা বিপদ সংকেত সহজেই সবার কাছে ছড়িয়ে দেয়া
- অসহায় মানুষের সহযোগীতা, রক্তদানের মত সামাজিক কাজে সহযোগীতা
- শিক্ষামূলক কাজে সহযোগীতা
- বিভিন্ন দেশ ও প্রকৃতির সচিত্র ডকুমেন্টারি ও তথ্যের সহজপ্রাপ্তি
- পণ্যের বিপণন
- জনসেচতনতা বৃদ্ধি
- নি:সঙ্গ মানুষের একাকী সময়ের বিষন্নতা দূরীকরণ
- কাছের মানুষের সাথে ছবি ও ভিডিও শেয়ারিং
- গুগলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পেতে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে সহযোগীতা পাওয়া
- লিংকডইন এর মাধ্যমে সহজে জব খুঁজে পাওয়া অথবা যোগ্য চাকুরী প্রার্থী খুঁজে পাওয়া
- এফিলিয়েটিং মার্কেটিং প্রভৃতির মাধ্যমে নিজের ব্যবসায়িক পণ্য বিপণন কিংবা অন্য কোম্পানীর পণ্য বিপণনে কমিশন লাভ
- ভিডিও কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে উপার্জন
- অর্থ্যাৎ একটি গণমাধ্যম হিসেবে যে সকল উপকারিতা পাওয়ার দরকার তার সব সুযোগ সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্তি প্রভৃতি
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের যে ক্ষতি করছে-
- মূল্যবান সময় নষ্ট করছে
- ইবাদত ও একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে
- ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে
- আসক্তি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে
- পরিবারের সদস্যদের সাথে গুণগত ও মূল্যবান (Qualitiful) সময়দান কমে যাচ্ছে
- পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল করে দিচ্ছে
- ভিনদেশী অপসংস্কৃতি ও অশ্লীলতা সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে
- সহজেই অপরিচিত ব্যক্তির সাথে অবাধ যোগাযোগের সুযোগ থাকায় হর হামেশাই সংসারে ফাটল ধরছে
- ভুল তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে
- ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে
- ফেইক একাউন্ট থেকে মিথ্যা তথ্য, উস্কানী ও রাষ্ট্রদ্রোহীতা করা হচ্ছে
- সহিংসতা দ্রুত ছড়িয়ে যায়
- ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হচ্ছে কিংবা হ্যাক্ড হচ্ছে
- হৃদরোগ, স্থুলতা, ডায়াবেটিস সহ শারিরিক ও মানসিক অসুস্থতা বাড়ছে
- কঠিন বাস্তব জীবনের পরিবর্তে সহজ ভার্চুয়াল লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে অকার্যকর একধরণের রোমান্টিক স্বপ্নে বিভোর থাকছে তরুণ প্রজন্ম
- যে কোন মানহীন অখ্যাত ব্যক্তি ও বস্তু সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছে এবং
- তা অনেকের জন্য অনুসরনীয় ও গ্রহণীয় হয়ে উঠছে
- অরুচিকর নিত্য নতুন মডেল ও উদ্ভট ডিজাইন, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, দুর্বিনীত আচরণ ও ওয়েব সিরিজ প্রভৃতি তরুণ প্রজন্মে মূল্যবোধ ও রুচিবোধ নষ্ট করছে
- নিত্য নতুন পদ্ধতিতে প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে প্রভৃতি
মোবাইল ফোন আসক্তি কি ?
মূলত স্মার্ট ফোনের মাধ্যমেই সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে মানুষ বেশি সময় ধরে বিচরণ করে এবং আসক্ত হয়ে উঠে। এই অসক্তিগুলো হলো:
- অত্যধিক পরিমাণে চ্যাটিং, মেসেজিং ও ডেটিং এপসগুলোতে সক্রিয় থাকা
- অত্যধিক ওয়েব সার্ফিং অর্থ্যাৎ এক সাইট থেকে আরেক সাইট, এক পেজ থেকে আরেক পেজ একের পর এক ব্রাউজ করতে থাকা
- পর্ণ ও অশ্লীল ভিডিও দেখা
- অনলাইন ও অফলাইন গেমস খেলতে থাকা
- সোশাল মিডিয়া এপসে বারবার নিউজ ফিড দেখা ও নোটিফিকেশন চেক করা। নতুন কন্টেন্টের অপেক্ষায় বারবার স্ক্রল করতে থাকা প্রভৃতি
মোবাইল ফোন আসক্তির স্বাস্থ্য ঝুঁকি
- মস্তিস্ক বিশ্রামের সুযোগ পায় না। ফলে প্রচুর চাপ সৃষ্টি হয়
- দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়
- ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলায় কান ও মুখের চোয়াল ক্ষতিগ্রস্থ হয়
- হেডফোনের কারণে কান গরম হয়ে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়
- ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে
- একাকিত্ব অনুভব করায়
- বিসন্নতা আচ্ছন্ন করে
- বিরক্তিভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠে
- কাজে মনোযোগ কমে যায়
- স্থুলতা, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়
- আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় বলা হয়েছে, মোবাইল ফোন থেকে নির্গত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন মস্তিস্কে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
- এই রেডিয়েশন থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা বন্ধ করে দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে
- এই রেডিয়েশন পুরষের শুক্রাণুর পরিমাণ কমিয়ে দেয়
মোবাইল ফোন ব্যবহারে সতর্কতা
- মোবাইলে কথা বলার পরিবর্তে মেসেজ, এসএমএস, চ্যাট বা নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বেশি যোগাযোগ করা
- মোবাইলে কথা বলার সময়ে ফোন সেট মাথা থেকে অন্তত এক ইঞ্চি সম্ভব হলে আরো দূরে সরিয়ে কথা বলা। এক্ষেত্রে লাউড স্পিকার অন করে কথা বলা যেতে পারে
- কথা সংক্ষেপে শেষ করা
- বেশিক্ষণ কথা বলতে হলে অপরজনের অনুমতি গ্রহণ করা
- অপ্রয়োজনীয় কল রিসিভ না করা
- বুক ও প্যান্ট পকেটের পরিবর্তে মোবাইল ফোন ব্যাগ অথবা হাতে বহন করা
- দুর্বল নেটওয়ার্ক সিগন্যালে কথা না বলা কারণ এই সময়ে রেডিয়েশন বেশি ঘটে
- যানবাহনে বসে মোবাইলে কথা না বলা কারণ মোবাইল ধাতব পদার্থের মাধ্যমে সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করে, ফলে রেডিয়েশন বেড়ে যায়।
- একান্ত জরুরি না হলে রাত ১০টার পর কাউকে ফোন না দেয়া, কারণ এ সময়ে মানুষ ঘুমানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে
- মোবাইলে নিজের ও পরিবারের একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ধারণ না করা। কারণ যে কোন সময়ে তা হ্যাকড কিংবা অসাবধানতায় হাতের চাপ পড়ে অন্যের কাছে চলে যেতে পারে
- শিশুদের থেকে মোবাইল ফোন দূরে সরিয়ে রাখা। মোবাইলে ভিডিও/কার্টুন দেখিয়ে তাদের খাওয়ানো-পড়ানোর বদ অভ্যাসে অভ্যস্ত না করা
- স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের হাতে মোবাইল ফোন না দেয়া
- মোবাইলে যে এপ্সগুলোর প্রতি আসক্তি তৈরি হচ্ছে তা ডিলিট করে দেয়া। প্রয়োজনীয় এপসগুলো ব্যবহারের সময়সীমা নিজের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া ও নিজে কঠোরভাবে মেনে চলা প্রভৃতি
আসুন, আমরা সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল ফোনের অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকি ও কল্যাণকর কাজে এসবের ব্যবহার নিশ্চিত করি।