শিরোনাম :

  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

মেঘেদের ঠিকানায়

নবনীতা দত্ত|

চাকার তলায় চিনির গুঁড়োর মতো বরফকুচি আর মাথার উপরে ক্যান্ডি ফ্লস মেঘ নিয়ে এসে পৌঁছলাম নাথাং গ্রামে। গাড়ির দরজা খুলেই সপাট বন্ধ করে দিলাম। এখানে নামা যাবে না। গাড়ি থেকে একটু মুখ বাড়াতেই মালুম হয়েছে ঠান্ডা কাকে বলে! নাথাং গ্রামের রাস্তায় নামামাত্র যেন দাঁতকপাটি লেগে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো বেড়ালের মতো ঝুপ্পুস অন্ধকারে ঢেকে গেল চার দিক। শোঁ শোঁ হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ্‌স। নাকের ভিতরটা জ্বালা করে উঠল ঠান্ডায়। তড়িঘড়ি হোমস্টেতে ঢুকে পড়লাম একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু এ কী! ভিতরে কিছুই ঠাওর হচ্ছে না যে। বাইরের মতোই ভিতরেও নিকষ অন্ধকার। পকেট থেকে ফোন বার করতে দেখলাম, তারও এনার্জি লাইন লাল হয়ে গিয়েছে। চার্জ প্রয়োজন। কিন্তু সে উপায় তো নেই। হোমস্টেতে ঢুকে জানা গেল যে, সন্ধের পরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। রাতে এক বার কারেন্ট আসে। সেই সময়েই খেয়ে নিয়ে ঘুমোনোর তোড়জোড় সেরে ফেলতে হবে। তখন বাইরের একফালি চাঁদকেই মনে হচ্ছে যেন হ্যালোজেন। তার ভরসায় করিডোর ঘেঁষে কোনও রকমে রুমে পৌঁছনো গেল। এত জার্নি করে এসে এমন জায়গা তো আশা করিনি। অন্ধকার ঘরে বাহারি লণ্ঠনের আলোয় সারা দিনের ক্লান্ত শরীরে তখন নিজেদের মনে হচ্ছে, ‘ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর’। কী দরকার ছিল এই দুর্গম জায়গায় ঘুরতে আসার! রোমাঞ্চে তখন বরফশীতল জল। স্থির করলাম ভোরের আলো ফুটতেই পাততাড়ি গুটিয়ে পালাব। কিন্তু আলো ফুটতেই আর এক বিড়ম্বনা। 

হ্রদমাঝারে: হাতির আকারের কুপুপ লেক

ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়েই বুঝতে পারলাম, এখান থেকে পালানোও অত সহজ নয়। বাথরুমে জল নেই। বাইরে এসে দেখি, দু’-চারজন মহিলা গরম জলের গামলা নিয়ে বাড়ির পিছন দিকে যাচ্ছেন। পিছু নিয়ে বুঝলাম, ট্যাঙ্ক ও পাইপ সমেত জল জমে বরফ। এই গরম জল ঢেলে জল গলালে তবে তা মিলবে বাথরুমে। অতঃপর আমরাও হাত লাগালাম। জলের সমস্যা মিটতে চোখ তুলে চারপাশে তাকানোর সুযোগ হল। আর তাতেই যেন ধাঁধা লেগে গেল দু’চোখে। যে পাহাড়ি গ্রামে রয়েছি, তাকে ঘিরে রয়েছে বিশালাকার একাধিক পাহাড়ের শৃঙ্গ। সামনের পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসছে পরপর মিলিটারি ট্রাক। চারপাশে সেনা ছাউনি। মিলিটারি গাড়ির আনাগোনা লেগেই রয়েছে সেই পাহাড়ি পথে। আর তারই মাঝে পথের একপাশে বসে পাথর ভাঙছে গ্রামের মহিলারা। বাদ যায়নি খুদেরাও। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোলাম নাথাং ভ্যালি ঘুরে দেখতে। সেই শোঁ শোঁ হাওয়া সঙ্গী করে পাহাড়ের বুক চিরে যত এগোতে লাগলাম, দু’পাশের বিস্তীর্ণ উপত্যকা যেন আরও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। চালক আঙুল দিয়ে দূরে চিনা ওয়াচ টাওয়ার দেখালেন। এই উপত্যকা ‘পূর্ব ভারতের লাদাখ’ নামেই পরিচিত। কিন্তু ১৩০০০ ফুট উঁচু এই উপত্যকার বুকে দাঁড়াতেই মনে হল এর অন্য পরিচিতির কোনও প্রয়োজন নেই। নাথাং স্বয়ংসম্পূর্ণ। উপত্যকার বুকে কিছু নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ অস্পষ্ট। চারপাশের পাহাড়ের মাথায় জমা হয়েছে মেঘ। মনে হচ্ছে যেন, পাগড়ি পরে জনাকয়েক বন্ধু বসেছে আড্ডায়। তাদের বৃত্তের মধ্যমণি এই নাথাং। সূর্যের আলোয় তখন সে উপত্যকা সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। তার উপরে দূরে দূরে চুনি-পান্নার মতো লাল-সবুজ সেনা ছাউনি। শীতে আবার পুরু বরফের চাদরে ঢাকা পড়ে যায় উপত্যকা। তখন এখানে স্কিয়িং চলে। কিছু দূর এগিয়ে আর্মি ক্যান্টিন থেকে গরম গরম ইনস্ট্যান্ট নুড্ল‌স আর কফিতে মজে গেলাম আমরা। চারপাশে ঘুরছেন ইন্ডিয়ান আর্মির জওয়ানরা। তাঁদের মধ্যে রাঁচির একজনের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি ন’মাস বাড়ি ফেরেননি। মাসখানেকের ছেলের ছবি দেখালেন বুকপকেট থেকে বার করে। ছেলের প্রথম জন্মদিনে বাড়ি ফেরারও ছুটি মেলেনি তাঁর। মুখে তবুও হাসি অমলিন। বললেন, ‘‘জ়িম্মেদারি হ্যায়, দেশ ভি তো অপনা হ্যায়।’’ এই বিস্তীর্ণ উপত্যকায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর মনে হল নিজেকে। সামান্য এক রাতের কষ্টে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম? মনে মনে স্যালুট করলাম সেই জওয়ানকে। কুপুপ লেক (হাতির আকারের এই হ্রদ এলিফ্যান্ট লেক নামেও পরিচিত) ও গল্ফ কোর্স দেখে এগোলাম গাড়ির দিকে। উপত্যকাকে পাশে নিয়ে গাড়ি চলেছে গ্রামের উদ্দেশে। আর গাড়ির পিছু নিয়েছে মেঘবালিকার দল। উপত্যকাকে আড়াল করে জানালার পাশে এসে তারা কানে দিয়ে গেল যেন ফুসমন্তর! কথা দিলাম, আবার আসব কোনও এক অবেলায়, মেঘেদের এই ঠিকানায়।