ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান বিশিষ্টজনের
মোট ১১৪ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু
করোনা তাণ্ডবে স্তব্দ নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটি
নিউজ ডেস্ক |
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন আরও ১০ জন বাংলাদেশি। তাঁরা হলেন দেওয়ান আফজল চৌধুরী , ব্যবসায়ী নুরুন নবী, মো. মানিক মিয়া, বোরহান উদ্দিন বাবুলের স্ত্রী, রতন চৌধুরী, ওয়াশিংটন ডিসির আব্দুল মান্নান, খন্দকার মোছাদ্দিক আলী (সাদেক), নিউইয়র্ক ট্রাফিক পুলিশের সদস্য জয়দেব সরকার (৫৫), আপ স্টেট নিউইয়র্কের বাফেলো সিটির মোহাম্মদ জাকির (৩৮) ও সামসুস জহির (৪০)।
এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় ১১৪ বাংলাদেশির মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনায় এমন তাণ্ডবে স্তব্দ বাংলাদেশি কমিউনিটি।
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে স্বামী রতন চৌধুরী ও স্ত্রী সুজাতা চৌধুরী সন্তানসহ এসেছিলেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। স্বামী-স্ত্রী কাজ করেন, দুই সন্তান স্কুলে যায়। করোনার বিপদসংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী ছুটি নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন। সন্তানরাও বাড়িতে। সুজাতা চৌধুরী নিজের অজান্তেই ভাইরাস বাড়ি এলেন কর্মস্থল থেকে। স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দুই সন্তানও আক্রান্ত হলো ভাইরাসে। হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ায় বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। ডাক্তারের নির্দেশনায় তিন বেডরুমের বাড়িতে স্বামী-সন্তানদের আলাদা রুমগুলো ছেড়ে দিয়ে সুজাতা নিজে জায়গা করে নিলেন ড্রইং রুমে। মধ্যরাতে রুমে রুমে গিয়ে চেক করেন, কে কেমন আছে। ১১ এপ্রিল ভোরে স্বামীর রুমে ওষুধ দেওয়ার জন্য ঢুকে কোনো সাড়া পেলেন না স্ত্রী। যা বোঝার বুঝে নিলেন তিনি। বাইরে থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানদের ডেকে তুললেন। সন্তানদের বললেন সবকিছু।
সুজাতা নিজেই ৯১১ নম্বরে কল করলেন। উত্তর পেলেন তাদের আসতে দেরি হবে। সারা দিন তিনজন অসুস্থ মানুষ বসে রইলেন তাঁদের অতি প্রিয়জনের মৃতদেহ নিয়ে। বিকেল চারটায় তিনজন স্যোসাল ওয়ার্কার এলেন। সঙ্গে এল না মর্গের গাড়ি বা কোনো সরঞ্জাম। তাঁরা জানালেন, তাঁদের অসহায়ত্বের কথা। সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। মর্গ বা অস্থায়ী ট্রেলারের মর্গে আছে জায়গার অভাব। কিছু মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়ার পর মর্গ কিছুটা খালি হলে তাঁরা নিয়ে যাবে মৃতদেহ।
প্লাস্টিকের ডাবল বডি ব্যাগে রতন চৌধুরীর দেহ ভরা হলো। স্ট্রেচারে বেঁধে স্প্রে করে রুমেই রেখে বন্ধ দরজায় ‘নো এন্ট্রি’ সাইন ঝুলিয়ে চলে গেলেন তিনি স্যোসাল ওয়ার্কার। এক রুমে প্রিয় স্বামীর মৃতদেহ, আর অন্য রুমে একই রোগে আক্রান্ত তিনজন মানুষ বসে আছেন।
সিলেটের খন্দকার মোছাদ্দিক আলী ব্রংকসে থাকতেন। নিউইয়র্ক, নিউজার্সিতে বসবাসরত বিশাল অভিবাসী পরিবারের সদস্য। নিজের তিন ছেলের একজন ডাক্তার। দুজন নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিকে কর্মরত। আমেরিকায় কোনো পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ পদের বাংলাদেশি এই পরিবারের সদস্য। ট্রাফিকে কর্মরত সন্তানের হাত ধরে ঘরে করোনার প্রবেশ। পরিবারের সবাই আক্রান্ত। ছেলে খন্দকার আব্বাসের শরীর নাজুক হতে থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হন। একপর্যায়ে চরম শারীরিক সংকট দেখা দেয়। ঘরের অন্যরা কম-বেশি অসুস্থ। অসুস্থ বাবা জায়নামাজে বসে সদ্য বিবাহিত সন্তানের রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাতে থাকেন। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আব্বাস ঘরে ফেরেন। খন্দকার মোছাদ্দিকের শরীর খারাপ হতে থাকে। ১১ এপ্রিল ভোরে হাসপাতালে নেওয়ার পরই তিনি মারা যান। আত্মীয়-স্বজন কেউ তাঁর কাছে যেতে পারছেন না। সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এই প্রবাসীর দাফন কখন হবে, স্বজনেরা তা মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা পরও জানাতে পারছেন না।
এর আগে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জনির পরিবারে ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা। কর্তব্য পালনকালে তাঁর শরীরে ঢুকেছিল করোনাভাইরাস। যখন পজিটিভ ধরা পড়ল, ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঘরে আক্রান্ত হন তাঁর বাবা। তাঁর বাবাকে সেবা দিচ্ছিলেন মা। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের নেওয়ার পর গত বুধবারে তাঁর বাবা অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মা অধ্যক্ষ রেনু সুলতানাও অসুস্থ। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদতেও পারছেন না জনি। একদিকে মা , অন্যদিকে তাঁর পেশাগত জীবন।
অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পিরোজপুর শহরের সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন। তাঁর সহধর্মিণী রেনু সুলতানা পিরোজপুর সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ছোট ছেলে জনির আবেদনে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্র্যান্ট হন। তাঁরা বাংলাদেশ ও আমেরিকায় আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। এমন কাহিনী নিউইয়র্কের সর্বত্র।
নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের বাংলাবাজার জামে মসজিদ ও স্টারলিং-বাংলাবাজার বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কমিউনিটির প্রিয়মুখ সমাজসেবী আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিনের দাফন সস্পন্ন হয়েছে। ১১ এপ্রিল বিকেলে জানাজা শেষে নিউজার্সির টেটোয়ায় বাংলাবাজার মসজিদের নিজস্ব কবরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়।
২৪ ঘণ্টায় আমেরিকায় ১ হাজার ৭১৯ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা। ফলে এই ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৫৭৭ জন।
প্রথমবারের মতো কোনো দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়াল। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে আরও ২৬ হাজার ৪৬৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৭৯ জন।