শিরোনাম :

  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

ভোট দেওয়ার কি তিন কারণ ?

এ আই এন হুদা ।।

ভোটের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়ার অধিকারী ছিল শুধু সাদাদের। পরে শুধু করদাতারা ভোট দেওয়ার অধিকার পায়। এর সঙ্গে তাদের ধার্মিক হতে হতো। মাত্র ছয়টি স্টেটে (৫০টির মধ্যে) ম্যারিল্যান্ড, ম্যাসাচুসেটস, নিউ ইয়র্ক, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া এবং ভারমন্ট কালো আফ্রিকানদের অধিকার দেয়। তবে মার্কিন সংবিধান ভোট দেওয়ার অধিকারের বিষয়টি স্টেটদের কাছে রেখে দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেই এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। তখন কণ্ঠভোটের পরিবর্তে লিখিত ব্যালটে ভোটের পদ্ধতিটি চালু হয়। ১৮৩০ সালে ১০টি স্টেট সাবালকদের ভোটাধিকার দেয়। তবে আফ্রিকানদের ভোটাধিকার আসতে আরো সময় লাগে। ১৮২৬ সালে মাত্র ১৬ জন আফ্রিকান (নিউ ইয়র্কের) ভোটের অধিকার পায়।

ভোটের পদ্ধতি নানা রকমের। এর মধ্যে পার্লামেন্ট পদ্ধতি ও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বেশি প্রচলিত। পার্লামেন্ট পদ্ধতি জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ তারা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ দেশে এখন পার্লামেন্টারি সরকার কায়েম হয়েছে।

মানুষ কেন ভোট দেয়? এর জবাব কঠিন। জবাব অনেক হতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে কারো ভোট একটি নির্বাচনকে নির্ধারণ করে না। তবে তারা ভোট দিতে কেন যায়? যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা এর ব্যাপক আলোচনা করে মোটামুটি তিনটি কারণ নির্ধারণ করেছেন। ১. নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মনে করে তাদের ভালো লাগে ২. এটা একটা সামাজিক নীতি ৩. ভোট দিতে ভালো লাগে। দেখা গেছে, শিক্ষিতরাই বেশি ভোট দেয়। যদিও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়।

ভোট নিয়ে সংঘর্ষ এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেন একটি অঙ্গাঙ্গি ব্যাপার। সারা বিশ্বের চিত্র একই। এই কর্মকাণ্ড হয় ভয়ংকর, যখন কোনো দল যদি মনে করে নিয়ন্ত্রণহীন সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের পরাজিত হওয়ার   আশঙ্কা রয়েছে, তখন তারা প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে নানা অজুহাতে সংঘর্ষ ও সংত্ঘাত সৃষ্টি করে ভীতির রাজ্য কায়েম করে।

আধুনিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। নির্বাচনই আধুনিক বিশ্বে রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। একই কারণে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার অন্ত নেই। স্বভাবতই কত সহজে এই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, তার অনুসন্ধানেরও শেষ নেই। এখন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নির্বাচনে নানাভাবে।

তার মধ্যে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার প্রধান। এছাড়া বিদেশে বসবাসরত নাগরিকরা ইন্টারনেটে ভোট দিতে পারছেন। এ পদ্ধতিও গ্রহণ করেছে বেশ কিছু দেশ। তবে ইভিএমের পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা সমালোচনা রয়েছে। বিশ্বের ২০টি দেশে এর পরীক্ষা হয়েছে এবং চালু আছে ১৩টিতে—আংশিকভাবে। অন্যরা দেশের বিভিন্ন অংশে এই ই-ভোটিং পরীক্ষা চালিয়েছে। ভারত এটাকে ব্যবহার করেছে এবং এটা চালু রাখতে চায়। হল্যান্ড, ইতালি এটাকে বাদ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও এটা বাদ দেওয়া হয়। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড কখনো এটা ব্যবহার করেনি।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠন ফ্রিডম হাউজের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২০’-এ গণতন্ত্রের পেছনযাত্রার চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের নিষ্ঠুরতা এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর নৈতিক অবক্ষয় একত্র হয়ে এমন প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, সুশাসন দাবি করাই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে গণতন্ত্র ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জন করেছে মাত্র ৩৭টি দেশে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছে ৬৪টি দেশে। আগের বছর ২০১৮ সালে যদিও গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছিল ৬৮ দেশে, কিন্তু উন্নতি হয়েছিল ৫০টি দেশে। এ অবস্থাকে কোনোভাবেই ইতিবাচক বলা যায় না। বৈশ্বিকভাবে যে গণতন্ত্রের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, সেটাও এ প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।

বিশ্ব  জুড়েই গণতন্ত্র একটা হুমকির মুখে পড়েছে। তা খুব ভালোভাবে বোঝা যায় যখন সেই দেশের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় না তখন। ক্ষমতাসীনদের দখলদারিত্ব, ডানপন্থিদের উত্থান বিশ্ব জুড়েই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সেই পথ ধরেই গণতন্ত্রও আজ বিশ্ব জুড়েই হুমকির মুখে। ইউরোপের কিছু দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা হয়, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের নির্বাচনে সহিংসতা হলেও সেখানে এখনো বিজয়ী দলকে স্বাগত জানানোর প্রথা, হার মেনে নেওয়ার প্রথা চালু রয়েছে। এর বাইরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পশ্চাদ্যাত্রা চোখে পড়ছে। এশিয়ার বেশির ভাগ দেশগুলোতে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ চালু রয়েছে। যেখানে সরকারি দলকে সমালোচনা করাও অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিরোধীদল সরকারি নিয়ন্ত্রণে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এসবের মধ্যে ব্যতিক্রম ভারত। যারা এখনো শত বাধার মুখেও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষভাবে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, গণতন্ত্রের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

শত বাধার মুখেও নির্বাচন এখনো গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে প্রাচীন গ্রিসেই প্রথম গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৮ সালে যে নির্বাচন পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সত্যিই আকর্ষণীয়। ভোটারদের ভাঙা মাটির ওপর যে প্রার্থীকে তারা আগামী ১০ বছরের জন্য নির্বাচিত করতে চায়, তার নাম লিখে জমা দিত। যদি এই ভোটের সংখ্যা ৬ হাজারের কম হতো তাহলে তাকে নির্বাচিতদের মধ্যে রাখা হতো। অর্থাত্ ‘না’ ভোট দিয়ে নির্বাচনের ইতিহাস। এর একটি ভালো অর্থও আছে। তা হলো, সবারই নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার আছে।

ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন নির্বাচনি আইনের মাধ্যমে এই ভোট ব্যবস্থা আধুনিক হতে থাকে। ১৮৭২ সালে গোপন ব্যালট পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং অবশেষে ১৯২৮ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয়।

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলো তা অনুসরণ করেছে। নারীদের ভোটাধিকার এসেছে সবার পরে মার্কিন সংবিধানের ১৮তম সংশোধনের মাধ্যমে। বিশ্বের সর্বত্রই নারীর ভোটের অধিকার পরে এসেছে। তবে এই উপমহাদেশে যখন ভোটের প্রচলন হয়, তখন নারী-পুরুষের সমান ভোটের অধিকার একবারেই আসে। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি নির্বাচন এ দেশটির ইতিহাস গড়ে, বিশ্বে এগুলো বিশাল প্রভাব ফেলে। এ নির্বাচনগুলো হলো ১৮০০, ১৮২৮, ১৮৭২, ১৯১২, ১৯২৮, ১৯৪৮ এবং ১৯৬৮ সালের নির্বাচনগুলো। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে ভুলগুলো নির্ধারণ হয়। ডেমোক্রেটিক পার্টি (১৮২৮) জন্ম নেয়, ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি সৃষ্টি হয় (১৮৭২), নির্বাচনি স্লোগানের জন্ম দেয়, চার দলের নির্বাচন (১৯৪৮) হয়।