• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সংবাদপত্রের প্রতিস্পর্ধী শক্তি বিনাশের অপআয়োজন

শওকত মাহমুদ

শওকত মাহমুদ :

সংবাদ, সংবাদপত্র, সাংবাদিক। মন-মগজে অনেকের কাছে এসব শব্দ অসহ্য। খবর ও মতপ্রকাশের ওপর লাগাতার পীড়নের সর্বশেষ হুংকার হল গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন ২০২২ এর প্রস্তাবনা। সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হরণ এবং নিছক ‘গণমাধ্যমের কর্মী’ বানিয়ে ফেলার এই মতলবী আইন-প্রস্তাব নিয়ে সাংবাদিক মোড়লেরা সেভাবে মুখ খোলেননি। সাধারণ সাংবাদিকরা অবশ্য ঢের উদ্বেগে আছেন। তারা জানেনই না, কোত্থেকে বা কেন এই আইনটির প্রণয়ন ও প্রস্তাবনা আর কারাই বা এটা চেয়েছে। এমন সন্দেহও আছে যে সব সাংবাদিক নেতা নতুন টিভির মালিক হয়েছেন, মালিক হিসেবে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিরংকুশ করতে সাংবাদিকদের পরিচয় এবং অধিকারশূন্য করাটা জরুরি। তাই এই অপআয়োজন।

আর সরকারি তরফে এই আইনটি সম্পর্কে এ রকম মুখটেপা হাসি আছে যে, ‘পদ্মার সংবাদ সব মৎস্যগণ জানে’।

সংবাদবিদ্যার ছাত্র হিসেবে জানি যে, গণমাধ্যম বা mass media এর সঙ্গে সংবাদপত্র বা Press এর একটা পার্থক্য আছে। সংবাদপত্রও গণমাধ্যম, কিন্তু একমাত্র গণমাধ্যম নয়। Press শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। গণমাধ্যমের যতোখানি সম্পৃক্ততা খবর সংগ্রহ ও পরিবেশনের সঙ্গে। চলচ্চিত্র, নাটক, বই, ইন্টারনেট, (এমনকি লিফলেটও) রেডিও-টিভি এসবও গণমাধ্যম কিন্তু সংবাদ মাধ্যম নয়। বাংলাদেশের বেসরকারি টিভিগুলো, নিউজ চ্যানেল বাদে, খবরও দেয় কিন্তু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বেশি। অতএব এর পরিচয় কি হবে গণমাধ্যম না সংবাদ মাধ্যম? বর্তমানের প্রায় অর্ধশত বেসরকারি টিভিগুলোর অধিকাংশ আওয়ামী লীগমনা বড় সাংবাদিকদের দখলে। তারা ঈর্ষণীয় বেতন-সুবিধায় চাকরি করেন। সাধারণ কর্মীরা নামেমাত্র বেতনে। কিন্তু ভাড়াটে বিনিয়োগকারী আছেন। মূলধন ছাড়া মালিক সিইও বা এডিটর পদ নিয়ে আছেন। তারা নিজেদেরকে শ্রমিক পরিচয় দিতে চান না। এদের কেউ কেউ ব্যাংকের মালিকও হয়ে গেছেন। কবে ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের ‘কলম পেষা মজুর’ বলে গেছেন, আজকাল কি ওসব মানায়! ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবের সদস্য তাঁরা। ওই হালে অভিজাত মিডিয়া ক্লাব পর্যন্ত হয়ে গেছে। অভিধান মতে, সংবাদকর্মী হচ্ছেন সাংবাদিক আর সংবাদ অর্থ খবর, সমাচার, বার্তা। সভ্যতার বয়স আর সাংবাদিকতার বয়সে খুব একটা হেরফের নেই। খৃস্টপূর্ব ৫৯ তে প্রাচীন রোমে Acta Diurna নামে খবরপত্র বের হত। বিশ শতকে সাংবাদিকতা সৃষ্টিশীল পেশাজীবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এই প্রণালীতে চারটি অবদান অনস্বীকার্য :-

১. কর্মীজীবী সাংবাদিকদের সংঘবদ্ধতা
২. সাংবাদিকতার পঠন-পাঠনের বিস্তৃতি
৩. গণযোগাযোগ বিদ্যার ও প্রযুক্তি ব্যাপক বিস্তৃতি
৪. সামাজিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অধিকতর সচেতনতার মনোবৃত্তি।

১৮৮৩ সালে বিলাতে চার্টার্ড ইন্সটিটিউট অব জার্নালিস্টস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজপেপার গিল্ডের মতো। এসব প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন এবং পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে কাজ করত। আমাদের উপমহাদেশে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও সাহিত্য কর্মের অবিস্মরণীয় অগ্রবর্তী ভূমিকা ইতিহাসে সাংবাদিক- লেখকদের অবস্থান নক্ষত্রস্বরূপ করে তোলে। তিরিশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম, পাকিস্তান আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ-সকল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামেই সাংবাদিকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬০ সালে ‘ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস কন্ডিশন্স অব সার্ভিসেস’ অধ্যাদেশের সূত্র ধরে ১৯৭৩ সালে নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন্স অব সার্ভিস) আইন সংসদে গৃহীত হয়। এ আইনে এবং প্রেস কাউন্সিল আইনে সংবাদপত্র, সাংবাদিক এবং অসাংবাদিক কর্মচারীদের সংজ্ঞা স্পষ্ট করে নির্ণীত হয়। যদিও সার্ভিসটাই তৈরি হয়নি। মোট কথা সাংবাদিকেরা শ্রমিক হিসেবে শ্রম আইনের সুবিধাগুলো পেতে থাকেন। তাছাড়া ওয়েজবোর্ড ও বেতন-সুবিধাগুলো সেইভাবেই স্থির করে দেওয়া হয়। শ্রমিক হিসেবে থাকার সুবিধার কারণে মালিকপক্ষ বেতন পাওনার বিষয়ে অন্যরকম কিছু করতে পারত না; শ্রম আদালতগুলো মোটামুটি কার্যকর আছে। স্বৈরাচারী এরশাদের সময় স্কপ বা শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ শ্রম আইনের একটা অভিন্ন কাঠামো দেবার অভিপ্রায়ে আন্দোলন শুরু করে এবং ২০০৬ সালে তখনকার সংসদের শেষ অধিবেশনে একটি অভিন্ন শ্রম আইন পাস করাতে সক্ষম হয়। স্কপের আন্দোলন যাতে না বাড়ে, সেজন্যে বিএনপি তখন মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এই শ্রম আইনে এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, সাংবাদিকেরা কর্মচারী থেকে শ্রমিক হয়ে গেছেন।

প্রস্তাবিত আইনে ‘গণমাধ্যম’ অর্থ প্রকাশ বা প্রচারের জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও নিবন্ধিত যে কোনো গণমাধ্যম, যথা-
ক. সংবাদপত্র
খ. সংবাদ সংস্থা
গ. টেলিভিশন,
ঘ. বেতার
ঙ. নিবন্ধিত অনলাইন গণমাধ্যম।

প্রচলিত আইনগুলোতে সাংবাদিক, অসাংবাদিক কর্মচারী সকলের সংজ্ঞায়িত পরিচিত ও দায়িত্ব ছিল পৃথক পৃথকভাবে। প্রস্তাবিত আইনে সবার এক পরিচয় ‘গণমাধ্যম কর্মী’। এর অর্থ গণমাধ্যমে পূর্ণকালীন কর্মরত সাংবাদিক, কর্মচারী এবং নিবন্ধিত সংবাদপত্রের মালিকানাধীন, ছাপাখানাসহ নিবন্ধিত অনলাইন গণমাধ্যমে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত কর্মী। কথা হচ্ছে, সীমিত অর্থে সাংবাদিক কিন্তু বহিরাঙ্গনে ব্যাপক পরিসরে গণমাধ্যম কর্মী। প্রস্তাবিত আইনেও তাই। এখন থেকে শ্রম আদালতের চাইতে মালিকরা স্বাভাবিক আদালতে গিয়ে সাংবাদিকদের পাওনা দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন।

প্রচলিত আইনগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাংবাদিকদের অনেক সুবিধা কেটে দেওয়া হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই, শ্রমিকই আর নেই। অফিসে অফিসে মালিকদের অনুমতিসাপেক্ষে সমিতি থাকতে পারবে। যেমনি করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া সাংবাদিকদের একটা নতুন সংগঠন হয়েছে। মালিকদের সুনজরপুষ্ট। সবার সার্ভিস বই থাকবে। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার, আর সরকার গঠিত ট্রাইব্যুনাল। সাংবাদিকদের পাওনা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। চাকরির বয়সসীমা এবং গ্র্যাচুইটি – দুটিই কমানো হয়েছে। শ্রম আইনে প্রদত্ত সুবিধাগুলো কর্তিত। অন্যদিকে, বেসরকারি গণমাধ্যমে সরকারের এবং মালিকদের কর্তৃত্ব নিরংকুশ করার প্রস্তাব হয়েছে।

সংবাদ মানে কী? চালু অর্থের পাশাপাশি এমন অর্থও আছে হরিচরণ চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দ কোষে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মত, ‘সংবাদ’ এখন গল্প প্রবাহ। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে ‘সংবাদ’ আরেক অর্থে অন্যেন্য ভাষণ, মিথ্যোভাষণ, অভেদবাক্য বা একরূপতা। নোয়াম চমস্কি যে অর্থে গণমাধ্যমের consent manufacturing বা মতৈক্য উৎপাদন বা প্রণালী বলেন, প্রাচীন অর্থে সংবাদ মানে তাই। অভেদবাক্য আজকের সরকারের কাছে ‘সংবাদ’ সব খবর এক রকম হবে। এর অর্থ প্রাচীনকালের মতই। যদি সংবাদ মাধ্যম সেমতে না চলে, তাহলে ওর অভিধা কেড়ে নাও। লেনি রিফেনস্থাল তথ্য পরিবেশনের নামে ‘ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল’ শীর্ষক যে নাৎসি প্রতিবেদনটি পেশ করেছিলেন তা প্রকৃত প্রস্তাবে তথ্যের অধিকার হরণ করে। যেখানে জার্মান জাতিতত্ত্বের ভ্রান্তিকে এতদূর পুরোভাগে নিয়ে আসা হয় যে, হিটলারকে দেবরাজ জিউস, স্বস্তিকা চিহ্নকে দেবতাদের কবচকুন্ডল এবং ‘এক নেতা এক দেশ’ স্লোগানকে নিত্যমন্ত্র হিসেবে মনে হতে থাকে।

এই প্রস্তাবিত আইনটির রাজনৈতিক দিক হচ্ছে, যখন সাজানো, ভুয়া নির্বাচনের প্রয়োজন হয়, তখন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে কণ্ঠরোধকারী কালো আইন। ২০১৪র নির্বাচনের আগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫২ ধারাকে সংশোধনপূর্বক অ-জামিনযোগ্য করে সাংবাদিকদের বেধড়ক গ্রেফতার করা হয়। ২০১৮এর মিডনাইট ইলেকশনের আগে আসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এখন এসেছে শীর্ণ, দীর্ণ পীড়িত সাংবাদিকদের পরিচয় মুছে দিয়ে তথাকথিত রক্ষার নামে বিলুপ্তির আইন। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের নিশ্চয়তার বিনিময়ে অধিকার কেড়ে নেবার অপউদযোগ। মালিকের যোগ্যতা, সম্পাদকের যোগ্যতা নিয়ে কোনো কথা নেই।

গণতন্ত্র যখন ফেরাতে পারছি না, আসুন না মেনে নেই আবারও এই বীভৎস আয়োজন। সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকার নামই তো সভ্যতা। ভুতুড়ে নির্বাচনের জন্য মুখ বেঁধে আমরা আবার অসহায় চোখে প্রত্যক্ষ করি গণতন্ত্রহীনতার পর্ব। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সদস্য মজিদ বিশ্বাস ভাই বাল্মীকির একটা মন্তব্য প্রায়ই তুলে ধরেন। সেটি হচ্ছে, ‘রাম যাহা বলে নাই, রাম ছাড়া তাহা আর কেহ বলিতে পারিত না’। কিন্তু আমরা কি নিশ্চুপ থাকব? নিশ্চয়ই নয়। সুরা নিসায় ১৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে স্মরণ রেখ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত’।

সংবাদপত্র একটা সামাজিক শক্তি। সমাজের মানসিকতাই তার শক্তির উৎস। জন্মলগ্ন থেকেই সংবাদপত্র প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী শক্তি। সংবাদপত্র, সমাজ ও পাঠকের মধ্যে গভীরতর বোঝাপড়ার জায়গাটুকু নষ্ট করতেই এই অমানবিক আইনের অপচেষ্টা।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেস ক্লাব।

Print Friendly, PDF & Email