মার্কিনীরা সরকারের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্টে হাত দিয়েছে !

? আবদুল হাফিজ খসরু ?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশের ব্যাপারে খুব আটঘাট বেঁধেই নেমেছে মনে হয়। বহুমাত্রিক স্বার্থ ছাড়া সহসা এমন সিদ্ধান্ত তারা নেয় না। গত দু’দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ভিসা বাতিলের নতুন নীতির ঘোষণা দিয়েছেন।

তার এই নীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। গতকাল বাংলাদশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় সাক্ষাতকার দেন। উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশকে পরিষ্কার মেসেজ দেয়া, যে আমরা তা বুঝতে পেরেছি। সম্ভবত বাংলাদেশের কোন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের এইরকম উচ্চপদের আমলার সাক্ষাতকার এবারই প্রথম!

গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ব সুপারপাওয়ার দেশটির উচ্চ পর্যায়ের এই তৎপরতা ও ভিসানীতি থেরাপির তাৎক্ষণিক ফলাফল হচ্ছে গতকাল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল কর্তৃক নৌকার পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হওয়া। এছাড়াও আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দকে মার্কিন দূতাবাসে ছুটে যেতে দেখা গেছে। কেউই দুনিয়ার স্বর্গ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা ছাড়তে রাজি নয়!

মার্কিন এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি সাক্ষাতকারে পরিষ্কার করে আরো বলেছেন, যারা ভোট চুরি-ডাকাতিতে জড়িত হবে, তাদের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে অর্থ্যাৎ পোষ্য কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। সবারই ভিসা বাতিল হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া কোন স্যাংশন নীতি কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করে।

ভিসা বাতিলের নতুন নীতিমালা সবার জন্যই প্রযোজ্য। যারাই নির্বাচনে বাঁধার সৃষ্টি করবে তাদের উপর তা প্রয়োগ হবে। সরকার বলছে, এ নিষেধাজ্ঞা বিরোধী দলগুলোর উপর প্রয়োগ হবে কারণ তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়। আদতে সরকার ও সরকারি দলের লোকজন যে এই মার্কিন ভিসানীতির টার্গেট তা স্পষ্ট। এটা সরকার দলীয় লোকজন, আমলা, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তাদের পরিবারকে অবশ্যই চাপের মধ্যে ফেলেছে। তাদের সন্তানদের পড়াশোনা, তাদের পাচার হওয়া অর্থ হুমকির মধ্যে পড়েছে। বাধাগ্রস্থ হবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বাংলাদেশের তৈরি পোষাকখাতের রপ্তানি আয়। যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি। রেমিটেন্স প্রবাহেও বাধা আসতে পারে।

চীন-রাশিয়া বলয় থেকে বাংলাদেশ বের না হওয়া পর্যন্ত আরো মার্কিন চাপ আসবে। সরকারের উপর এই চাপ সরকার বিরোধীদের জন্য আপাত সুখকর বিষয়। অথচ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন মার্কিনীরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছিল। ক্ষেত্রবিশেষে তারা বিরোধী দলগুলোকে রাজপথে আন্দোলন বন্ধ করে আলাপ-আলোচনার পরামর্শও দিয়েছিল। পরিণতি যাই হবার তাতো হলো। দেশের বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল। এখন জিওপলিটিক্যাল স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের প্রতি তারা বেশ মনোযোগী হয়েছে। ভারতের চশমা পরে বাংলাদেশকে আর মূল্যায়ন করতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। তাই সরাসরি হ্যান্ডেল করতে চাইছে। এই ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্টে তারা হাত দিয়েছে। তারা কোন স্যাংশন দেয়নি কিন্তু টার্গেটেড লোকদের ভিসা বাতিল করছে ও আরো করতে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে, যারা এতদিন বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেছিল, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলো তাদের সেকেন্ড হোমে যাতায়াতের পথ রূদ্ধ করে দিলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল তারা পাবে।

এখন বিরোধীদের পক্ষে একটি সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষ অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা সহজ হবে। মিছিল-সমাবেশ করার রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি আপতত স্বাভাবিক রাখতে চাইবে সরকার। অনির্বাচিত স্বৈরশাসকগোষ্ঠী মসনদ রক্ষার্থে স্বল্পমূল্যে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠা করে না। সরকার যদি মার্কিন টোপ গিলে ফেলে তাহলে বিরোধীদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বহুমুখী স্বার্থ আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে নিয়ে আর কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা সময় বলে দিবে। ততদিনে বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিত্বশীল সরকার কায়েম হোক, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাক এই প্রত্যাশা সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের।

Print Friendly, PDF & Email