সৈকতের প্রধান ‘বায়ো টার্বেটর্স’ লাল কাঁকড়া

সৈকতের মাটির তাপমাত্রা যখন ৪৮ ডিগ্রী কাঁকড়ার গর্তের তাপমাত্রা ৩২!

আহমদ গিয়াস ♦

লাল কাঁকড়া কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কেবল সৌন্দর্য বর্ধনকারী একটি প্রাণী নয়, সৈকতের একটি অপরিহার্য বা প্রধান ‘বায়োটার্বেটর’; যে প্রাণী বা উদ্ভিদ মাটি বা কাদার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে মাটির গুণাগুণের পরিবর্তন ঘটায় তারাই ‘বায়োটার্বেটর’।

লাল কাঁকড়া বায়োটার্বেশনের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক গুণাগুণের বা বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটিয়ে খাদ্য সার্কেলের বিভিন্ন জীব-অনুজীব ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার মত পরিবেশ তৈরি করে। সৈকতের মাটির লবণাক্ততাও হ্রাস করে লাল কাঁকড়া বা Red ghost crab (রেড ঘোস্ট ক্র্যাব)।

তীব্র গরমের সময় কক্সবাজার সৈকতের বালুকাময় মাটির উপরের তাপমাত্রা যখন ৪৮ ডিগ্রীতে ওঠে, তখন কাঁকড়ার গর্তের তাপমাত্রা থাকে মাত্র ৩২ ডিগ্রী। ৯ থেকে ১৭ ইঞ্চি গর্ত করে এই কাঁকড়া মাটির নীচে অক্সিজেন সরবরাহ করে। গর্ত তৈরি মাধ্যমে সে ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রা থেকে যেমন রেহাই পায়, মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর কবল থেকেও বাঁচে। এতে মাটির নীচের ক্ষুদ্র প্রাণীকুলের বসবাসের জন্যও আদর্শ তৈরি হয়।

বিজ্ঞানী-গবেষকদের মতে, কক্সবাজার সৈকতের লাল কাঁকড়া একটি নিখুঁত ও অবিকল্প পরিবেশ প্রকৌশলী। একটি নিখুঁত স্থপতি, ভূ-রাসায়নিক প্রকৌশলী, জৈবিক প্রকৌশলী, ভৌত প্রকৌশলী ও জলবায়ু প্রকৌশলী। প্রকৃতিতে তার বিস্তৃত সেবা সম্পর্কে গবেষণায় দিনদিন নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। আর ইতোমধ্যে যা জানা গেছে তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও কয়েকখন্ডের মহাগ্রন্থে পরিণত হবে।
লাল কাঁকড়া ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য জালগুলিতে একটি মূল পরিবেশগত সংযোগ তৈরি করে। মাটিতে থাকা জৈব পদার্থের বন্টনের পরিবর্তন ঘটায়। রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পলি মাটিতে থাকা বিভিন্ন প্রাণীর খাবার উন্মুক্ত করে ও খাবারের গুণগত পুষ্টিমান বাড়িয়ে তুলে। এছাড়া লাল কাঁকড়া মাটির লবণাক্ততাও কমায় এবং পানিতে কার্বন সরবরাহের মাধ্যমে অগভীর সামুদ্রিক জলজ পরিবেশের পানির কলামে রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

লাল কাঁকড়া তার গিল এর মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে। অক্সিজেন গ্রহণের সুবিধার্থে সে সমুদ্র উপকুলের সোয়াশ ও সার্ফ জোন (সর্বোচ্চ জোয়ারভাটার নীচের স্তর, যা ওঠানামা করে) এর পলি মাটি থেকে তার গিলগুলিতে আর্দ্রতা মিশিত করে। এতে পলি কণায় পানির জৈবিক পরিবহণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং রাসায়নিক গুণাগুণ পরিবর্তন করে দেয়। সে পানিতে কার্বনও সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে সে পানির কলাম ঠিক রাখে।

লাল কাঁকড়ার ইংরেজি নাম Red ghost Crab, আর প্রাণীতাত্ত্বিক, বৈজ্ঞানিক নাম Ocypode macrocera. এই ক্রান্তীয় প্রাণীটিকে খাদ্যের প্রাপ্যতা ও মানুষের আচরণের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের প্রায় সকল উষ্ণ মন্ডলীয় ও অর্ধ উষ্ণমন্ডলী সৈকতে দেখা যায় ।

লাল কাঁকড়া সর্বভুক প্রাণী, মানে যা পায় তা খায়। তবে সৈকতের মাটিতে থাকা কাদা বা পলল থেকে উদ্ভিদ বা প্রাণীর গলিত অংশ বের করে যখন সে খায়, তখন মাটিতে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে যায়। এতে মাটির বন্ধন তৈরি হয়, মাটি থেকে দূষিত পদার্থ দূরীভূত করে বায়ু দূষণ হ্রাস করে। এছাড়া মাটি থেকে কাদা হ্রৃাস পাওয়ায় বালুকনাগুলো শুষ্ক ও হালকা বস্তুতে পরিণত হয়ে বালিয়াড়ি তৈরিতে সহায়ক হয়। এভাবে লাল কাঁকড়া মাটিতে লবণের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে ভ‚-পৃষ্ঠের প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ ঠিক রাখে।

লাল কাঁকড়ার অভ্যাসগত কার্যক্রম সমুদ্রের নোনা পানির সাথে ভ‚-গর্ভস্থ মিঠাপানির প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র তীরের বালিয়াড়িগুলোর মাত্র ১০ ফুট গভীরে টিউবওয়েল বসিয়েও স্বচ্ছ ও মিঠাপানি পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বালিয়াড়িগুলোতে সামুদ্রিক লোনা পানির ধাক্কা লাগে। তবু এখানে ১০ ফুট এর নীচেই থাকে মিষ্টি পানির মজুদ। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি স্বচ্ছ পানির তুলনায় অনেক ভারী হলেও এক অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা ভ‚-পৃষ্ঠের মিঠা পানির স্তরকে নিরাপদে রেখেছে।

তবে কক্সবাজার শহরের সমুদ্র তীরবর্তী পর্যটন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে ভ‚-গর্ভস্থ পানির উপর অতিরিক্ত চাপের কারণে পানির স্তর প্রায় ৩শ ফুট নীচে নেমে যায়। এসময় উপরের স্তরগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটে। তবে শহরতলীর দরিয়ানগর বড়ছড়া এলাকার আশেপাশের অগভীর নলকুপগুলোতে লবণ পানি ওঠে আসে না। সমুদ্র তীরে কৃষিকাজও ভাল হয়। মোহনায় লাল কাঁকড়ায় আবাসও রয়েছে। বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদরাজি লতা-গুল্মের জীববৈচিত্রও রয়েছে।

গর্ত তৈরিতে স্থাপত্যবিদ্যা, আবহাওয়া বিদ্যা
গবেষণা থেকে জানা যায়, বসবাস ও বংশ বিস্তারের জন্য লাল কাঁকড়া সৈকতের মাটিতে যে গর্ত তৈরি করে, তা করা হয় এক নিখুঁত স্থাপত্য কৌশল ও আবহাওয়া কৌশলের সাহায্যে। শিল্পী বা স্থপতি হিসাবে তার গাণিতিক ও জ্যামিতিক দক্ষতা নিখুঁত। সে ইংরেজি আই, জে, এল, ইউ এবং অর্ধ ইউ আকারের গর্ত তৈরি করে। সাধারণত: গর্তের গভীরতা হয় ৯ থেকে ১৭ ইঞ্চি পর্যন্ত। আর গর্তের সর্বনিম্ন অবস্থান থাকে পানির লেভেলের প্রায় ১/৩ ইঞ্চি (এক সেন্টিমিটার) উপরে। এই প্রকৌশলের মাধ্যমে সে ভ‚-পৃষ্ঠের উপরের তাপমাত্রার সাথে গর্তের নীচের তাপমাত্রায় নাটকীয় পার্থক্য তৈরি করে। যদি ভূ-পৃষ্ঠের উপরের তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রীতে ওঠে, তাহলে গর্তের ভেতরের তাপমাত্রা থাকে ৩২ ডিগ্রীতে।

এই কৌশলের মাধ্যমে সে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে রক্ষা করে। আবার মাটির নীচে অক্সিজেন সরবরাহ করে, মাটির নীচের তাপমাত্রা সহনীয় রেখে অন্যান্য জীব-অনুজীবের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।

লালকাঁকড়ার প্লাঙ্কটনিক লার্ভা মাইক্রো এলগি-সহ অনেক অনুজীবের খাদ্য। তার ডিম থেকে খুব কমই বাচ্চা ফোটে এবং বড় হয়ে পরিবেশে ফিরে আসে। একটি লাল কাঁকড়া বাঁচে প্রায় ৩ বছর পর্যন্ত। মরে গেলেও সে অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য হয়। তার শরীরের শক্ত অংশগুলো মাটিকনায় পরিণত হয়। সে নিজে নিখুঁত শিকারী আবার কিছু প্রাণীর শিকারও। আর প্রকৃতির এ কৌশল থেকে সবাই লাভবান হয়, কারো ক্ষতি হয় না। তাই সমস্ত প্রশংসা লাল কাঁকড়ার সৃষ্টিকর্তার জন্যই।

আহমদ গিয়াস, সিনিয়র সাংবাদিক, কক্সবাজার।

১৬ মে, ২০২০।

Print Friendly, PDF & Email