লিঙ্গ নয়, মানবিক গুণাবলি

নম্র ও সহানুভুতিশীল নেতারাই করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে সফল

সিওয়াই গোপীনাথ, ভারতীয় লেখক

ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপরাষ্ট্র সিন্ট মার্টেন। মাত্র ৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির জনসংখ্যা ৪২ হাজার ৮৪৪ জন। এখানে পূর্ণাঙ্গ সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সিলভিয়া জ্যাকবস। ৫১ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী আগে শিক্ষকতা করতেন।

বছরে প্রায় ৫ লাখ পর্যটক এ দ্বীপটিতে ঘুরতে যান। গত ১১ মার্চ নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়ার পরপরই পর্যটনে কঠোর বিধিনিষেধ চালু করা হয়।

পরদিন ১২ মার্চ, আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশটির প্রধান উৎসব কার্নিভাল স্থগিত ঘোষণা করেন। এর পাঁচ দিন পর এক ফরাসি দম্পতির মাধ্যমে দেশটিতে প্রথম করোনা সংক্রমণ শুরু হয়।

সিন্ট মার্টিনে আইসিইউ বেড আছে কেবল দুটি। ভাইরাসটির বিস্তার শুরু হলে দ্বীপের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তা মারাত্মক আকার ধারণ করবে একথা জানতেন জ্যাকব।

এদিকে, লকডাউনের পক্ষেও তিনি ছিলেন না। তার মনে হয়েছিল, মানুষকে বোঝাতে পারলেই, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলেই মহামারি রোধ করা যাবে।

গত ১ এপ্রিল তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘চলাফেরা বন্ধ করুন। কেউ বাসা থেকে বের হবেন না। যদি হাতের নাগালে পছন্দের রুটি না থাকে তাহলে যা আছে তাই খেয়ে থাকুন। বিস্কিট, সিরিয়াল, শুকনো মাছ- যা হাতের নাগালে পাওয়া যায় সেটি খেয়েই বাঁচুন।’

তিনি জনগণকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছেন যে, মহামারির সময়ে বিলাসিতা করা চলবে না। করোনা মোকাবিলার জন্য সবাইকেই কষ্ট করতে হবে।

এখন পর্যন্ত সিন্ট মার্টেনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৭৭, মারা গেছেন ১৫ জন।

বিশ্বে করোনা মোকাবিলায় সফল দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে তাইওয়ান (মৃত্যু ৭), নিউজিল্যান্ড (মৃত্যু ১১), আইসল্যান্ড (মৃত্যু ১০), ফিনল্যান্ড (মৃত্যু ৩২৩), নরওয়ে (মৃত্যু ২৩৮) ও জার্মানি (মৃত্যু ৮ হাজার ৭৭৬)।

জার্মানির ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যাটা বেশি হলেও জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যাটি কম। 

মহামারিতে সবচেয়ে বেশি দক্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা এ সব কয়টি দেশই নারী সরকারপ্রধান দ্বারা পরিচালিত। এই তালিকায় আরও যুক্ত হবেন ভারতে করোনা মোকাবিলায় সফল রাজ্য কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা। কেরালায় এখন পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ১৫।

অন্যদিকে, সবচেয়ে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচে আছে ডনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র (মৃত্যু ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি ), জ্যা বলসোনারোর ব্রাজিল (মৃত্যু ৩৮ হাজার ৪০৩ ), ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া (মৃত্যু ৬ হাজার ৩৫০), বরিস জনসনের যুক্তরাজ্য (মৃত্যু ৪০ হাজার ৯৬৮) ও নরেন্দ্র মোদির ভারত (মৃত্যু ৭ হাজার ৭৪৫)।

তবে কি মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে নারীরাই পুরুষদের চেয়ে বেশি দক্ষ?

একথা সত্যি যে, পুরুষ নেতৃত্বে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও গ্রিসের মতো দেশগুলোও করোনা মোকাবিলায় সফল, এদেশগুলোতে মৃতের হার কম। অন্যদিকে, নারী নেতৃত্বে থাকা দেশ বেলজিয়ামে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।

নেতৃত্বে থাকা মানুষটি নারী না পুরুষ এটি জরুরি না, জরুরি হলো একজন ভালো নেতার বৈশিষ্ট্য।

কেবল কঠোর নিয়ম নয়, নারী সরকারপ্রধানরা এর পাশাপাশি জনগণের প্রতি সহানুভূতি, উষ্ণতা দেখিয়েছেন।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ্যার্ডেনের কথাই ধরা যাক। তিনি বাড়িতে বসে সাদামাটা পোশাক পরেই নিয়মিত ফেসবুক লাইভে আসেন। নিজ পোশাকের জন্য ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই একসাথে আছি। সবাই সবার পাশেই থাকব।’

তিনি মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি, মানুষের জীবনকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। যখন ট্রাম্প কিংবা শি জিনপিংয়ের মতো নেতারা অন্যকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত, তখন তিনি শান্তির কথা বলেছেন। তার সংবাদ সম্মেলনে কখনো ভাইরাসটির জন্য কোনো দেশ, কোনো নেতাকে দোষারোপ করা হয়নি।

অন্যদিকে, অ্যার্ডেনের মতো মমতা ও সহানুভূতিশীলতার জন্য বিখ্যাত নন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল। কোয়ান্টাম রসায়নে পিএইচডি করা মের্কেল মহামারির সময়ে চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন।

মহামারী মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষাকেই যে জোর দিতে হবে এটা খুব সহজভাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেই তিনি স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার মতো সহজ কৌশল হাতে নেন। জার্মানির হাসপাতালগুলোতে এখনো অনেক অব্যবহৃত আইসিইউ রয়েছে যা তারা প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্সের রোগীদের ব্যবহারের জন্য দিয়েছে।

একইভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মহামারি মোকাবিলা করতে দেখা গেছে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন ইয়াকোবস্টডিটিকে। তার নেতৃত্বে দেশটিতে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা জানতে ঝুঁকিতে থাকা সকল মানুষের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে দেশটি ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি মানুষের করোনা পরীক্ষা করেছে। আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করতে প্রযুক্তির সাহায্যে শক্তিশালী ব্যবস্থা চালু করেছে। অন্যান্য দেশের মতো আইসল্যান্ডে লকডাউন হয়নি এমনকি স্কুলগুলোও বন্ধ করা হয়নি।

লকডাউনের সময় ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেতে ফ্রেদেরিকসেন নিজ হাতে ঘরের কাজ করছেন, থালাবাসন মাজছেন এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন।  

প্রযুক্তি ব্যবহার করে সচেতনতা তৈরির দৃষ্টান্ত রেখেছে ফিনল্যান্ডে। গত ডিসেম্বর দেশটিতে নির্বাচিত হয়েছেন বিশ্বে সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী সানা মেরিন। নেতৃত্বে আসার পরপরই করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেন তিনি।

দেশের সব মানুষ সংবাদপত্র না পড়লেও অধিকাংশ মানুষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকে বলে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনলাইন ক্যাম্পেইন শুরু করেন তিনি।

হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক ডা. জো মার্কস বলেন, নারীর সহজাত বৈশিষ্ট্য সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো শক্তিশালী আর কিছুই নেই।

লন্ডনের কিংস কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রোজি ক্যাম্পবেল বলেন, মহামারীর বিরুদ্ধে নম্রতা এবং সহানুভুতিশীল হয়েছেন এমন নেতারাই সবচেয়ে কার্যকর প্রমাণ করেছেন। করোনার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে দৃঢ়তার পাশাপাশি মানবিকতা থাকা জরুরি। লিঙ্গ নয় বরং নেতৃত্বের মানবিক গুণাবলিই এখানে মুখ্য।

(মুম্বাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিড ডে’তে প্রকাশিত ভারতীয় লেখক সিওয়াই গোপীনাথের মতামতের বাংলা অনুবাদ ।)

ডিএন/ওপেনিয়ন/বিএইচ

Print Friendly, PDF & Email