• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

গল্প একজন প্রধানমন্ত্রীর

সৈয়দ আবদাল আহমদ ?

একটি দেশের গল্প। একজন মানুষের গল্প। গল্প একজন প্রধানমন্ত্রীর। দেশটি হলো নিউজিল্যান্ড। আর মানুষটি সেদেশের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন।
সততা, আন্তরিকতা ও সত্যিকার দেশপ্রেম থাকলে যেকোনো অসাধ্যই যে সাধন করা সম্ভব, সেটা আবারও প্রমান করে দেখালো প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপদেশ এই নিউজিল্যান্ড। সারা পৃথিবীর দৃষ্টি দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের দিকে। তাঁকে এখন ‘করোনাজয়ী প্রধানমন্ত্রী’ বিশেষণে অভিহিত করা হচ্ছে। তাঁর সরকারও এজন্য ব্যাপক প্রশংসিত।

এক বছর আগে তিনিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সংকটময় এক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ব্রেটন ট্যারেন্ট নামের এক শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর নৃশংস হামলায় ৫১ জন মুসলমান নিহত হলে দেশটিতে নেমে আসে ভয়াবহ সংকট। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে মুসলমানদের মন জয় করে সেই সংকটের মোকাবিলা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলের ভাষায়, তাঁকে তখন ‘ট্রু মাদার অব হিউমিনিটি’ বা সত্যিকারের মানবতার মাতা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

গত ৮জুন করোনাভাইরাসকে ‘গুডবাই’ জানায় নিউজিল্যান্ড। এখন পর্যন্ত নতুন কোনো করোনা রোগী সনাক্ত হয়নি দেশটিতে। জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন জেসিন্ডা। দেশকে করোনা রোগীমুক্ত ঘোষনা করে ওইদিন তিনি বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ড এখনকার মতো ‘এ যুদ্ধে জিতেছে ‘। তবে কেউ আত্মপ্রসাদে ভোগবেন না। আপাতত ভাইরাস সংক্রমন রোধ হয়েছে। তবে বার বার তা আমরা খতিয়ে দেখব। প্রধানমন্ত্রীর দেশকে করোনা মুক্তির ঘোষণার পর নাগরিকরা উল্লাস প্রকাশ করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ে।

নিউজিল্যান্ডের তারকা ক্রিকেটার জিমি নিশাম টুইট করেন-“আমরা করোনাভাইরাস মুক্ত। তিনটি বৈশিষ্ট্যে সফল হয়েছি- সঠিক পরিকল্পনা, দৃঢ়তা ও টিম ওয়ার্ক।”

১৯ মার্চ যখন দেশটিতে লকডাউন ঘোষণা হয়,তখন রোগী ছিল ৩০ জন। এপ্রিলের শেষে শূন্যের কোটায় নেমে আসে। মে মাস থেকে কড়াকড়ি তুলে নেয়া শুরু হয়। মোট সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৫২৮ জন। এরমধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৫০৬ জন। ২২ জন মারা গেছেন। সেখানে পাঁচ সপ্তাহ কড়াকড়ি লকডাউন ছিল। জেসিন্ডা সরকারের নেয়া সময়োপযোগী এবং কার্যকরী পদক্ষেপের ফলেই মহামারি জয় করার সফলতা পেয়েছে নিউজিল্যান্ড।

জেসিন্ডা আরডার্ন নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। এর আগে জেনি শিপলে এবং হেলেন ক্লার্ক নামে দুজন নারী এ দায়িত্ব পালন করেন। জেসিন্ডা ৩৭ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এ সময় তিনি ছিলেন অন্তঃসত্বা। ২০১৮ সালের জুনে তিনি একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান প্রসব করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো তাকে টুইট করে অভিনন্দন জানান। কারন বেনজির ভুট্টোও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপালনকালে সন্তান প্রসব করেন। সেটি ছিল বিলওয়ালের জন্ম । টুইটে বিলওয়াল মায়ের সাথে তার ছোটবেলার ছবিও জুড়ে দেন। জেসিন্ডা ভালোবেসে বিয়ে করেন টেলিভিশন উপস্থাপক ক্লার্ক গেফোর্ডকে। জেসিন্ডা নিউজিল্যান্ডের ৪০তম প্রধানমন্ত্রী এবং সেদেশের লেবার পার্টির সভাপতি। জন্ম ১৯৮০ সালে। পড়াশোনা করেছেন ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজনীতি ও গণসম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা স্কুলের সহকারী। জেসিন্ডা সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক এবং সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সাথে কাজ করেছেন।

২০১৯ সালের মার্চে ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনায় জেসিন্ডা বিশ্ব মিডিয়া ও মানুষের নজর কাড়েন। এ হামলায় ৫১ জন মুসলিম নিহত হলে তিনি সংকট কাটিয়ে উঠতে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। হামলার দিনটিকে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে অন্ধকার দিন হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন,মুসলমান সমপ্রদায়ের সাথে কিউই জনগন আরও সম্পৃক্ত হয়েছে। নিজে কালো পোশাক পরেন। মাথায় দেন মুসলিমদের মতো হিজাব।

জেসিন্ডা নিজে একজন শ্বেতাঙ্গ নারী। ইচ্ছা করলে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর পৈশাচিক কাজটি দেখেও না দেখার ভান করতে পারতেন। এতে ইসরায়েলসহ তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্টত্ববাদীদের সমর্থনও পেতেন। কিন্তু তিনি সে রাস্তায় হাঁটেননি। জঘন্য ঘৃনায় না জড়িয়ে মানবতাকে বড় করে দেখেছেন। মমতা ও ভালোবাসার কী প্রবল শক্তি সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। সরকারি খরচে নিহতদের দাফন, গণপ্রার্থনা,সংসদে কোরআন তিলাওয়াত, জাতীয় স্মৃতিচারণের আয়োজন এবং হতাহতের পরিবারের সাথে দেখা করে সহমর্মিতা জানিয়েছেন।

নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, “নিহতরা আমাদের, নিউজিল্যান্ড তাদের দেশ।” সংসদে দেয়া ভাষনে বর্বরতা, হয়রানি, বর্ণবাদ ও বৈষম্যমুক্ত জাতি গড়ে তোলার অঙ্গিকার করেছেন। এভাবে জেসিন্ডা সবার মন জয় করেছেন। একইসাথে একটি বড় সংকটের ইতি ঘটিয়েছেন। একজন মানুষ যদি সততার সাথে বলেন যে, তিনি তার জনগনের জন্য ভালো কিছু করতে চান এবং সে লক্ষে কাজ করেন তাহলে সেটা করা তার জন্য কঠিন নয়। এটাই জেসিন্ডা আরডার্নের শিক্ষা।

ডিএন/মতামত/বিএইচ

Print Friendly, PDF & Email