শিরোনাম :

  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে কী করবেন?

অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হাসান, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ :

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার দ্রুত বাড়ছে। এই অবস্থায় কেউ আক্রান্ত হোন বা না হোন—কিছু উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া উচিত। এই রোগের নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ না থাকলেও আশার কথা যে এরই মধ্যে  কিছু ওষুধ দিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে এবং এর ফলও মিলছে।

চিকিৎসার উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমটা হলো, মৃত্যুহার শূন্যতে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা। অর্থাৎ কভিডে আক্রান্ত হলেও কেউ যেন মারা না যায়। দ্বিতীয়ত, একজন মানুষ থেকে অন্যজনে কভিড সংক্রমণের হার অর্থাৎ কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের হারও শূন্যতে নামিয়ে আনা।

দ্বিতীয় ধাপটি অনেকটা চ্যালেঞ্জের হলেও প্রথম ধাপটি শুরু করা সম্ভব। এর জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু করা। কারণ রোগটি যখন অনেক গভীরে চলে যায় বা রোগী যখন বেশ অবনতির দিকে চলে যায়, তখন রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।

শক্তিশালী ভাইরাস
ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ভাইরাস। এটি যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন মানুষের দেহে ব্যাকটেরিয়ার যে শক্তি থাকে, এই ভাইরাস সেই শক্তিটিও খর্ব করে দেয়। অনেকে মনে করেন, ভাইরাল ইনফেকশন হওয়ার পর হয়তো ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কা অনেক কম। মানুষের দেহকে খারাপ করে দেওয়ার জন্য এ ভাইরাস একাই যথেষ্ট।

এ ভাইরাস নিজেই নিউমোনিয়া, এআরডিএস তৈরি করে, রক্তনালির ভেতর রক্ত জমাট বাঁধায়, কিডনিসহ অন্যান্য অর্গানকে ফেইলিওর করে ইত্যাদি।

কিছু পরীক্ষা
কেউ করোনাভাইরাস দ্বারা বা কডিভ-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে কি না তা শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর পরীক্ষাটিই এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা। নির্ধারিত ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা করাতে হয়। এর বাইরে র‌্যাপিড টেস্ট কিট দিয়ে ব্যাপক হারে পরীক্ষা করে আক্রান্তদের শনাক্ত করে আইসোলেশনে নেওয়া সম্ভব। এতে বাকিরা বা যারা আক্রান্ত নয়, তারা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে বলে আশা করা যায়।

তবে সর্দি-জ্বর, কাশি, মাথা ব্যথা—যা-ই হোক না কেন, শুরুতেই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। এর মধ্যে একটি হলো পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখা, যা ছোট একটি মেশিনের মাধ্যমে বাসায় বসে করাও সম্ভব।

মানুষের স্বাভাবিক অক্সিজেন স্যাচুরেশন থাকে ৯৫ শতাংশের ওপর। কিন্তু কারো যদি ৯০ শতাংশের নিচে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে আসে, তখনই সতর্ক হতে হয়। তখন সন্দেহ করতে হবে, হয়তো ফুসফুসের সংক্রমণ হয়ে গেছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯২ থেকে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত নিচে নেমে গেলে বুঝতে হবে, ফুসফুসে মাঝারি ধরনের সংক্রমণ হয়েছে। এর নিচে চলে গেলে বুঝতে হবে, ফুসফুসে মারাত্মক ধরনের বা সিভিয়ার সংক্রমণ হয়েছে। এ অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে।

ওই সময় কভিড শনাক্তকরণ টেস্ট ছাড়াও বুকের এক্স-রে, সিবিসি ও সিআরপি—এই তিনটি পরীক্ষা করা উচিত। যদি সিবিসি নরমাল থাকে, সিআরপি-২০-এর ওপরে থাকে এবং ফুসফুসে সামান্য সাদা সাদা দাগ থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, ফুসফুসে করোনাভাইরাসের ইনফেকশন হয়েছে। তখন পরিপূর্ণভাবে কভিড রোগী মনে করেই চিকিৎসা দিতে হবে, যাতে অক্সিজেন দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

ওষুধ নিয়ে কিছু কথা
কভিড-১৯-এ আক্রান্তদের জন্য নির্ধারিত কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার না হলেও সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত রোগীদের অনেক ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে সফল হওয়ার কথা বেশ শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে আইভারমেকটিন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের নাম বেশ আলোচনায় এসেছে। এর সঙ্গে ফেভিপিরাভির, রেমডেসিভির ওষুধের সঙ্গে কনভালসন প্লাজমা থেরাপির কথাও জানা গেছে। শুধু তা-ই নয়, খোদ বাংলাদেশে এগুলো এরই মধ্যে কভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট ফল মিলেছে বলে জানা গেছে।

তবে আশার কথা, শুরুতে রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জন্য শুরুতেই আইভারমেকটিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া যেতে পারে। এই ওষুধ বেশ কার্যকর। তবে এজিথ্রোমাইসিন বা ডক্সিসাইক্লিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা সামান্য। এ ক্ষেত্রে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

করণীয়
মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটি প্রতিরোধ করা যায়। তবে শুরুতেই চিকিৎসা গ্রহণ করা ভালো। এ জন্য যা করণীয় তা হলো—

► এক দিনের জ্বর, ঠাণ্ডা বা কাশির যেকোনো রোগী হলে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর ওজন ৬০ কেজির মধ্যে হলে দুটি আইভারমেকটিন ৬ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট খালি পেটে খাইয়ে দিতে হবে যেকোনো সময় একবার। ওজন ৬০ কেজির বেশি হলে তিনটি ট্যাবলেট মাত্র একবার দিতে হবে। এই ওষুধ স্কাবো, আইভেরা, পারাকিল নামেও বাজারে পাওয়া যায়।

► এর সঙ্গে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সকালে দুটি এবং রাতে দুটি ট্যাবলেট মাত্র এক দিন খাওয়াতে হবে। এটি দেশের বাজারে রিকোনিল ২০০ নামে পাওয়া যায়।

মনে রাখবেন, এক দিনের জ্বর বা কাশি শুরু হলে তিনি অ্যাজমা বা সিওপিডির রোগী যা-ই হোন না কেন, তিনি আইভারমেকটিন আর হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন—এই দুটি ওষুধ চোখ বন্ধ করে খেয়ে নেবেন। আশা করা যায়, এই দুটি ওষুধ খাইয়ে দিলে রোগীর জটিল হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এর সঙ্গে অ্যাজমা বা অন্যান্য উপসর্গের ওষুধও খাবেন।

► দুই সপ্তাহ পর কারো যদি আবারও জ্বর আসে তাহলে এই ওষুধগুলো আবার খাওয়া যাবে। একই সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শে বুকের এক্স-রে সিবিসি ও সিআরপি পরীক্ষা করা উচিত।

জটিল হলে
► এটা গুরুত্বপূর্ণ যে যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে এসেছে, তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে অথবা বাসায় রেখে অক্সিজেন দিতে হবে।

► এরই মধ্যে যাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে তাদের রেমডেসিভির ওষুধ শুরু করা উচিত।

►কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্তরা গুরুতর বা জটিল পর্যায়ে চলে যায়। তখন চিকিৎসকের অধীনে বা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ফেভিপিরাভির ট্যাবলেট ৪০ কেজির ওপরে ওজন হলে সকালে আটটি রাতে আটটি প্রথম দিন এবং পরবর্তী সময়ে সকালে তিনটি রাতে তিনটি করে ৭ থেকে ৯ দিন খেতে হবে।

► ৫০-এর ওপরে বয়স হলে প্রতি রাতে একটি রিভারক্সাবান ট্যাবলেট কমপক্ষে ১০ দিন থেকে এক মাস খেতে হবে। তবে যাঁরা অ্যাসপিরিন বা ক্লোপিডোগ্রেলজাতীয় রক্ত তরলের ওষুধ আগে থেকেই সেবন করছেন তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ সেবন করবেন না। বিশেষ করে হৃদরোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।