সাংবাদিকের ‘গ্রেডহীন’ লাশ!
জাহাঙ্গীর আলম আনসারী ✍
প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার চীফ রিপোর্টার ও নগরসম্পাদক, বৃহত্তর কুমিল্লা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও সাংবাদিক সমাজে প্রিয় মুখ হুমায়ুন কবীর খোকন। করোনার উপসর্গ নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রাত সাড়ে ৯ টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর পরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষার জন্য সেম্পল নেয়। বুধবার সকালে পজেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর থেকে তার স্ত্রী-সন্তনেরা হোম আইসোলেশনে আছেন।
মানুষ মরণশীল। প্রত্যেক মানুষকে একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। নির্ধারিত হায়াত শেষ হলে মউত আসবেই। ইচ্ছে করলেও কেউ এক সেকেন্ড বেশি থাকতে পারবে না। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু মৃত্যু আছে যেগুলো মানুষের মনে দাগ কেটে যায়। মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যেমন-সিলেট ওসমানী মেডিকেলের ডা. মাইনুদ্দিনের মৃত্যু। তার চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে কঠোর সমালোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা নিয়েও।
এখন অনেকেই বলতে পারেন, সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের চিকিৎসায় তো কোনো অবহেলা ছিল না। রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খোকনকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। তার হায়াত শেষ ছিল। তাই তিনি চলে গেছেন। এটা নিয়ে তো আর বিশেষ আলোচনার কিছু নাই। না, তার মৃত্যু নিয়েও আলোচনার আছে। দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকা কর্তৃপক্ষে বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সব গণমাধ্যম যখন তাদের কর্মীদেরকে বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, তখন ওই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাদের সংবাদকর্মীদেরকে অফিসে আসতে বাধ্য করেছেন। চাকরি বাঁচাতে তারা জীবনের ঝঁকি নিয়েও অফিসে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ওই পত্রিকার আরও একাধিক সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে শুনা যাচ্ছে। যদি অভিযোগগুলো সত্য হয় তাহলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই কর্মীদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।
তারপর সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের লাশের মান নিয়েও কথা আছে। কোনো চিকিৎসক, নার্স ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বেতনের গ্রেড অনুযায়ী তাদের লাশের জন্য সরকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের লাশ কি কোনো গ্রেডে পড়ে? তিনিও তো দেশ ও জাতির স্বার্থে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। নাকি তারটা ‘গ্রেডহীন’ লাশ?
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস যখন দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো তখনই চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি সামনে আসে। তাদের সুরক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পিপিই’র ব্যবস্থা করা হয়। তখন প্রশ্ন আসে জীবনের ঝঁকি নিয়ে মাঠে ময়দানে কাজ করা গণমাধ্যমে কর্মীদের বিষয়টিও। তাদের পিপিই ব্যবস্থা করার জন্যও সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠে। কিন্তু তাদের সুরক্ষা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। ব্যবস্থা করা হয়নি পিপিই’রও। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একের পর এক গণমাধ্যমকর্মীরাও প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হতে থাকেন। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৩০ জনের মতো সাংবাদিক প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এরপর, সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসক, নার্স, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত বা মৃত্যু হলে বেতন গ্রেড অনুযায়ী তাদের লাশের জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে, ১-৯ গ্রেডে বেতন প্রাপ্তরা আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ টাকা, আর মারা গেলে পাবেন ৫০ লাখ টাকা। ১০-১৪ তম গ্রেডে বেতন প্রাপ্তরা আক্রান্ত হলে পাবেন ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আর মারা গেলে পাবেন ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১৫-২০তম গ্রেডে বেতন প্রাপ্তরা আক্রান্ত হলে পাবেন ৫ লাখ টাকা, আর মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা।
কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে-ঘাটে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনার দাবি জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মিলেনি। সবাইকে প্রণোদনা দেয়া শেষে সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল শুধু একটু ধন্যবাদ। বার বার সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জন্য ধন্যবাদ শব্দটা শুনে গ্রামের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।
আমাদের গ্রামে হায়দার আলী নামে একজন কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। আমরা তাকে দাদা ডাকতাম। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন গল্প বলে মানুষকে খুব হাসাতে পারতেন। লোকজন একবার তাকে জিজ্ঞেস করলো-চাচা তুমি এই কাম আর কতদিন করবা? জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন-শবেবরাতের রাতে আল্লাহ হাওরের জমিগুলো ভাগ করে সবাইকে দিতে দিতে ফজরের আযানের সময় হয়ে যায়। সব জমি শেষ, সময়ও শেষ। তখন বলে-হায়দার তোর জন্য মিস্ত্রীর কামই থাকলো। এজন্য জমির ভাগ আর আমি পাই না। তাই হাতুড়ি-বাটাল নিয়েই কাজ করতে হয়।
করোনাকালে সরকারি প্রণোদনাও এইভাবেই চলছে। সবার শেষে সাংবাদিকদের জন্য থাকে শুধু ধন্যবাদ। এটা নিয়েই সাংবাদিকদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
সারাদেশে প্রাণঘাতী করোনায় কয়েকশ চিকিৎসক, নার্স ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন।
ইতিমধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্য মারাও গেছেন। কেউ আক্রান্ত হোক বা মারা যাক এটা আমরা কখনো কামনা করি না। তারপরও যারা আক্রান্ত হচ্ছেন বা মারা গেছেন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী তাদের পরিবার বিশেষ প্রণোদনা পাবেন। এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পেনশন সিস্টেম আছে। আল্লাহ না করুন, তারপরও কেউ মারা গেলে তাদের পরিবারকে একেবারে পথে বসতে হবে না।
কিন্তু, একজন সাংবাদিক মারা গেলে তার পরিবারের ভবিষ্যত কি? কেউ কি কখনো এ নিয়ে চিন্তা করেছে? পেনশন সিস্টেম তো দূরের কথা অধিকাংশ গণমাধ্যমে ঠিক মতো বেতনই হয় না। অনেক গণমাধ্যম আছে সরকার থেকে সুবিধা নিয়েও তারা কর্মীদেরকে বেতন দিচ্ছে না। অনেক সাংবাদিকেরই পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটে। এসব দেখার কেউ নাই। এসব নিয়ে ভাবারও কেউ নাই।
খুব কষ্টের সঙ্গেই বলতে হয়, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও ধন্যবাদ ছাড়া সাংবাদিকদের ভাগ্যে প্রণোদনার কোনো গ্রেড মিলেনি। এ হিসাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মারা যাওয়া সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের লাশকে আমরা ‘গ্রেডহীন’ লাশ বলতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ-মানুষের স্বার্থে কাজ করে গেলেও সরকারি ঝুঁকির খাতায় তার নাম নেই।এখন আমরা যদি বলি যে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম এখন রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার তাহলে কি ভুল হবে?
প্রথম দিকে কয়েকজন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের মৃত্যুর পর এ আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। এই আতঙ্ক দূর করে দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে কোনো উৎসাহীত করা হচ্ছে না। অনেক সাংবাদিক এখন শুধু চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে-ঘাটে দায়িত্ব পালন করছেন।
মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার মালিক আল্লাহ। তাই আমরা এখন মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের লাশ দুনিয়ার কোনো গ্রেড না পেলেও তুমি তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ গ্রেডে আসীন করো। আর যেসব সহকর্মী দেশ ও মানুষের স্বার্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই দুর্যোগের সময় দায়িত্ব পালন করছেন, তুমি তাদেরকে রহমতের চাদর দ্বারা ঢেকে রেখো।
লেখক: সাংবাদিক