শিরোনাম :

  • বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭৮ জন সাংবাদিক

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দেশে গত পাঁচ মাসে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) অন্তত ৬৭৮ জন গণমাধ্যম কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২৭ জন। আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশিই রাজধানীতে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মী। আক্রান্তের তুলনামূলক তথ্য না থাকলেও সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে আক্রান্তের হারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও চিকিৎসকদের পরেই গণমাধ্যম কর্মীদের অবস্থান বলে ধারণা গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের। কাজের ক্ষেত্রগত কারণেই গণমাধ্যম কর্মীরা তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা মনে করেন। এছাড়া বেশিরভাগ গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলেও তারা জানান। এর বাইরে কিছু গণমাধ্যম কর্মীর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনীহাকেও দায়ী করেন তারা।

গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, করোনাযুদ্ধে সম্মুখভাগের অন্য পেশাজীবীরা যাদের সংস্পর্শে আসেন তাদের সম্পর্কে ধারণা থাকলেও গণমাধ্যম কর্মীরা সংস্পর্শে আসাদের সম্পর্কে কোনও ধারণা রাখার সুযোগ পান না। কারণ, একজন চিকিৎসক কোভিড, নন-কোভিড যে ধরনের রোগীই দেখেন না কেন, তিনি প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের সুযোগ পান, কিন্তু একজন সাংবাদিককে পেশাগত কারণেই হাসপাতাল থেকে মাছের বাজার পর্যন্ত ছুটে বেড়াতে হয়। এ সময় যাদের সংস্পর্শে তাকে আসতে হয়, তাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তার কোনও ধারণা পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এর ফলে প্রতিনিয়ত নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছাকাছি যাওয়ায় সংবাদ কর্মীদের একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত গণমাধ্যম কর্মীদের অধিকাংশই তাদের পরিবারের একাধিক সদস্যসহ আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্তের ২৬ দিনের মাথায় গত ৩ এপ্রিল প্রথম কোনও গণমাধ্যম কর্মীর করোনা শনাক্ত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবেই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। দেশের প্রথম সাংবাদিক হিসেবে ২৯ এপ্রিল সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খোকনের মৃত্যু হয় করোনায়।

গণমাধ্যম কর্মীদের আক্রান্তের তথ্য কোনও সরকারি বা গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকে সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই গণমাধ্যম কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ ‘আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার’ করোনা আক্রান্ত গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়মিত হিসাব সংরক্ষণ করছে। এই গ্রুপের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২৯ জুলাই পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত গণমাধ্যম কর্মীর সংখ্যা ৬৭৮ জন এবং এ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৭ জন, যাদের মধ্যে ১৭ জনের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি ১০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে। দেশের ১৫৭টি গণমাধ্যমের আক্রান্ত ৬৭৭ জন কর্মীর মধ্যে ঢাকায় ৪৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ২১৩ জন। এদিকে আক্রান্ত ১৫৭টি গণমাধ্যমের মধ্যে ৯৪টি পত্রিকা, ৩০টি টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন নিউজপোর্টাল ২৭টি, রেডিও পাঁচটি এবং বার্তা সংস্থা একটি। সংবাদকর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে একাধিক জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেল লকডাউনও করা হয়।

করোনায় মারা যাওয়া গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে আরও রয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, জবাবদিহির সহকারী সার্কুলেশন ম্যানেজার শেখ বারিউজ্জামান, এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের কক্সবাজার প্রতিনিধি আব্দুল মোনায়েম খান, বগুড়ার উত্তরকোণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক, ভোরের ডাক পত্রিকার চান্দিনা (কুমিল্লা) প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা, যশোরের নওয়াপাড়া পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বেলাল হোসেন, বগুড়ার সাপ্তাহিক হাতিয়ারের নির্বাহী সম্পাদক সাইদুজ্জামান, সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সম্পাদক খন্দকার মোজাম্মেল হক, সাপ্তাহিক উত্তমাশার সম্পাদক খন্দকার ইকরামুল হক, এটিএন বাংলার অর্থ ও হিসাব বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহসান হাবীব, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল, গোপালগঞ্জের পাক্ষিক মকসুদপুর পত্রিকার সংবাদকর্মী এম ওমর আলী, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বার্তা সম্পাদক আবদুল্লাহ এম হাসান, ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান এবং ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাহান পত্রিকার সম্পাদক রেবেকা ইয়াসমিন। 

এছাড়া উপসর্গ নিয়ে মৃতদের মধ্যে রয়েছেন—সময়ের আলোর সিনিয়র সাব-এডিটর মাহমুদুল হাকিম অপু, ভোরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার আসলাম রহমান, বাংলাদেশের খবরের প্রধান আলোকচিত্রী মিজানুর রহমান খান, দৈনিক বগুড়া পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ওয়াসিউর রহমান রতন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সিনিয়র সাংবাদিক সুমন মাহমুদ, দৈনিক সমাচার ও চাঁদপুর জমিন পত্রিকার ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক আবুল হাসনাত, আজকের সিলেটডটকমের বালাগঞ্জ প্রতিনিধি লিটন দাস লিকন, রাজশাহীর দৈনিক সোনালী সংবাদের চিফ রিপোর্টার তবিবুর রহমান মাসুম, ফেনীর সাপ্তাহিক হকার্সের প্রকাশক ও সম্পাদক নুরুল করিম মজুমদার এবং সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মহসিন হোসেন।

গণমাধ্যম কর্মীদের আক্রান্তের তথ্য সংরক্ষণকারী ‘আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার’-এর সমন্বয়ক আহম্মদ ফয়েজ বলেন, ‘আমাদের হালনাগাদে আক্রান্তের যে সংখ্যা আমরা প্রকাশ করছি, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়ে কিছুটা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না।’

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো করোনা সংকটকালে কর্মপদ্ধতি কী হবে বা কীভাবে এই সংকটে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায়, তা নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার সময় ও সুযোগ দুটোই হাতছাড়া করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাংবাদিকরা বা গণমাধ্যমগুলো কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো খুব একটা খোঁজ-খবর করেনি।

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকার যেভাবে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে, একইভাবে গণমাধ্যমগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে একটি গাইডলাইন প্রণয়ন জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় মতামতের ভিত্তিতে অন্তত আগামী দুই বছরের জন্য অফিসের ভেতরে ও বাইরের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।’

গণমাধ্যম কর্মীদের আক্রান্তের হার বেশি হওয়ার জন্য মালিক কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব সাজ্জাদ আলম খান তপু। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগ কর্তৃপক্ষের। আমরা শুরু থেকেই এটা বলে আসছি। রাজপথে দাঁড়িয়ে দাবি করেছি। তবে দুঃখজনকভাবে সত্য হলো— বেশিরভাগ কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্বটা পালন করেনি। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করেনি। কেউ কেউ করলেও সেখানে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা হয়নি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে—এই ঘটনার সময় অনেক মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেককে ফোর্স করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।’

ডিএন/এমএন/বিএইচ/০৬ঃ৫০এএম/৩০০৭২০২০-১