জৈন্তাপুরে ওয়াজ মাহফিলে আটরশী পীরের (তথাকথিত) অনুসারী সন্ত্রাসী কতেৃক পিটিয়ে মাদ্রাসা ছাত্র হত্যা, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩

jointopurসিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার আমবাড়ী এলাকায় ওয়াজ মহফিলকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও প্রায় শতাধিক লোক আহত হয়েছে।

সোমবার দিবাগত রাত ১০টায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

সংঘর্ষের পর একটি পক্ষের কয়েক হাজার লোক দেশিয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আমবাড়ী গ্রামের ৪৫ টি ঘরবাড়িসহ কেন্দ্রি গ্রামে অবস্থিত জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমানের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

jointopurঘটনায় নিহতরা হলেন- হরিপুর মাদ্রাসার দাওরা হাদিস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র গোয়াইনঘাট উপজেলার ডৌবাড়ী মুজ্জাম্মিল হোসেন (২৮), আমবাড়ী গ্রামের সাইদুর রহমানের শিশু কন্যা সাদিয়া আক্তার (৩ মাস)। .এ.জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গোয়াইনঘাট উপজেলার সিটিংবাড়ী গ্রামের আব্দুল কাদির (২২) মৃত্যু হয়।

আজ মঙ্গলবার সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান, এডিসি জেনারেল শহিদুল ইসলাম, জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌরীন করিম, সহকারি কমিশনার (ভূমি) মুনতাসির হাসান পলাশ, জৈন্তাপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ খাঁন মো: মঈনুল জাকির, অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আনোয়ার জাহিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।ঘর পুড়ানো এবং মারামারির ঘটনায় এডিসি জেনারেলকে (সার্বিক) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মাওলানা মোজ্জাম্মিল হোসেনের জানাজার নামাজের দৃশ্য

সরজমিন পরিদর্শনে এলাকার জনপ্রতিনিধি, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, স্থানীয় আমবাড়ী জামে মসজিদে গতকাল সোমবার ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। কওমী মাদ্রাসার আলেমরা বাধা দিয়ে বলেন এলাকায় মাজারপূজারী বেদ’আতি, আটরশীরা কোনো প্রোগ্রাম করতে পারবে না। কোরআন শরীফ, হাদীস বিকৃতি করে কোনো ওয়াজ সেখানে হবেনা। প্রশাসন নিষেধ করেছে। শেষপর্যন্ত তাদের পীড়াপীড়িতে প্রশাসন কর্তৃক সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, অত্র এলাকায় ওয়াজ করতে হলে কওমি আলেম-ওলামাদের নিয়ে ওয়াজ করতে হবে। তারা সানন্দ্যে মেনে নিলো।
আটরশীরা দিন তারিখ ঠিক করে ওয়াজ শুরু করলো কওমি একজন আলেমকে দাওয়াত দিয়ে। কওমি আলেম মাওলানা আব্দুসসালাম সাহের ৫০ জন ছাত্র নিয়ে মাহফিলে আসেন । কওমি আলেম মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেব স্টেইজে বসা। এমতাবস্থায় আটরশীর একজন ভক্ত ওয়াজ করছেন। যেসময়ই আটরসির বক্তা বলেন “নবী নূরর তৈরী” তখন কওমী আলেম বলের আপনি একথা কোরআন হাদিসে কোথায় পেয়েছেন দলীল দেন বলে ভুল সংশোধন লাগলেন। কিন্তু কী সংশোধন করবেন, উনি বলে ওঠলেন আপনি জানেন কোরআনের অর্থ! তিনি জনসাধারনের উদ্দেশ্যে বলেন আমি আপনাদের মেহমান, আমাকে অপমান করা হচ্ছে অ্পনারা বসে থাকবেন ?  এই শুরু। তারপর উচ্চবাক্য । মাওলানা আব্দুসসালাম সাহেব ও তার ছাত্রদের মারধর।এসময় পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত ।  
অপরদিকে ঘটনার সংবাদ পেয়ে হরিপুর এলাকায় বিভিন্ন মসজিদে মাইকযোগে ওয়াজে হরিপুর মাদ্রাসার শিক্ষকসহ ছাত্র নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচার করে সবাইকে সহযোগীতার করার আহবান জানানো হয়। তাক্ষণিকভাবে উপজেলা জুড়ে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে।

সংবাদ পেয়ে উপজেলা বিভিন্ন কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ অন্য লোকজন গাড়িযোগে দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজিত হয়ে আমবাড়ী এলাকায় আসলে অ্টরশীর অনুসারীরা পালিয়ে যায় ।  লোকজনের বসতবাড়িতে হামলা করে অগ্নিসংযোগ করে। এতে আমবাড়ী গ্রামের ৪৫ টি ঘরবাড়ি নিমিষেই আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায়্ । এদিকে বুধবার কওমী ্আলেমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন ্আটরিশীর অনুসারীরা ঘটনা অন্য দিকে প্রবাহিত করতে নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন দিয়েছে ।

এসময় জীবন বাঁচাতে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে আমবাড়ী গ্রামের সাইদুর রহমানের ৩ মাসের শিশু কন্যা সাদিয়া আক্তারের মৃত্যু হয়। এছাড়া আহত হন ছবিলা খাতুন(৬৫), কুলছুমা বেগম(২৬), ফিরোজা রেগম(৩৫), নাছিমা বেগম(৩৫), হুসনা বেগম(৪০), মোহাম্মদ আলী(৮০), মিনারা বেগম(৬০), শফিকুর রহমান(৪০), সাথী বেগম(১৮), মো: আব্দুর রহিম(২৮), সানা উল্লাহ(৫৮), জেসনা বেগম(৪০), জাবেদা বেগম(১৫), আনোয়ারা বেগম(৪০), নাছিমা বেগম(৪০), হাসিনা বেগম(৪০), রজির আহমদ(৪০), রেকিয়া বেগম(৫০)।

হামলাকারীরা ফেরার পথে রাত ৩টায় দিকে জৈন্তাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কেন্দ্রি গ্রামের বাসিন্দা এখলাছুর রহমানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত করে।জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে আটরশীদের পক্ষ নিয়ে আসছেন । তার অনুসারীরাও কওমী আলেমদের উপর হামলার অভিযোগ উঠে ।

ওয়াজ মাহফিলে সংঘর্ষের সময় হরিপুর মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক আহত হন। তারা হলেন- হেমু পাখিটিখি গ্রামের অব্রু মিয়ার ছেলে আবুল কালাম(২৩), কানাইঘাট উপজেলার বড়বন্দ গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে এনাম(১৮), জৈন্তাপুর উপজেলার উপরশ্যামপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে মাছুম(২০), দরবস্ত গর্দনা গ্রামের মতসিন আলীর ছেলে রুহুল আমিন(২০), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কামাল বস্তি গ্রামের বদরুল আলমের ছেলে হোসেইন আহমদ(১৮), গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াক্কুল গ্রামের মৃত শফিকুর রহমানের ছেলে আলীম উদ্দিন(২৪), সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রাধানগর গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে আশরাফ আলী(১৮), জৈন্তাপুর উপজেলার সেনগ্রামের মুহিবুর রহমানের ছেলে দেলোয়ার(২২), গোয়াইনঘাট উপজেলার লহর গ্রামের আখলু মিয়ার ছেলে শিহাব উদ্দিন(২৩), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কামালবস্তি গ্রামের ডাক্তার শফিকুর রহমানের ছেলে নুরুজ্জামান(২২), জৈন্তাপুর উপজেলার উপরশ্যামপুর গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে ফরিদ আহমদ(২৫), সিলেট সদর জালালাবাদ পাটিনুরা গ্রামের রশিদ আলীর ছেলে মাসুক আহমদ(২২), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মৃত সিকন্দর আলীর ছেলে আব্দুল বাছিত(২৫), জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর উৎলার পার গ্রামের আব্দুর রবের ছেলে মাসুক আহমদ(৪০), জৈন্তাপুর উপজেলার হেমু হাউদপাড়া গ্রামের ইমাম উদ্দিনের ছেলে বিলাল আহমদ(৩৪), কানাইঘাট উপজেলার কাজির পাতন গ্রামের মাহমুদ আলীর ছেলে আরিফ আহমদ(২১), জৈন্তাপুর উপজেলার খারুবিল গ্রামের মো: আব্দুল্লাহর ছেলে রেজওয়ান করিম(২০), জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ভিতর গ্রামের আজির উদ্দিনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন(২২), আইয়ুব আলীর ছেলে ফখরুল ইসলাম(২৩), দরবস্ত ডেমা গ্রামের মুনতাসির(২২), নুরুজ্জামানের ছেলে মোহাম্মদ আলী(২৫), জৈন্তাপুর উপজেলার খারুবিল গ্রামের ইস্রাক আলীর ছেলে মাওলানা আব্দুস সালাম(৫৫), গোয়াইনঘাট উপজেলার পাঁচপাড়া গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে নিজাম উদ্দিন(২২), জৈন্তাপুর গ্রামের মাওলানা আজির উদ্দির(৪০), জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত গর্দনা গ্রামের শামসুল হকের ছেলে আব্দুস সালাম(২০)।

জৈন্তাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমান বলেন, বিগত বছর থেকে এধরনের ওয়াজ মাহফিল নিয়ে স্থানীয় কওমী মাদ্রাসার বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে মতপার্থক্য চলে আসছে। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একাধিকবার বৈঠক হলেও নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হওয়াতে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট বিষয়টি হস্তান্তর করা হয়। গতকাল একটি অংশ ওয়াজের আয়োজন করা হলে অপর অংশের লোকজন ওয়াজ মাহফিলে আক্রমণ করলে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। কি কারণে আমার বাড়িতে হামলা ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।

এবিষয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌরীন করিম জানান, ঘটনার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেয়া হয়। ঘটনাস্থল আমবাড়ী গ্রামে মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। হতাহতদের নগদ অর্থ সাহায্য এবং তাদের মধ্যে কম্বল ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

এবিষয়ে জেলা প্রশাসক রাহত আনোয়ার সাংবাদিকদের জানান, এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা স্বার্থে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এলাকায় যাতে আর কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয় সে জন্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করে বিষয়টির মূল কারণ উদঘাটনের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এঘটনায় আমবাড়ী এলাকার বেশকিছু ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হওয়ার কারণে প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা প্রস্তুত করে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে আর্থিক সহায়তা, কম্বল ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আমরা সবাই ছুটে এসে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এছাড়া সরকারের পক্ষ হতে সকল ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছি। ঘটনার সাথে যেই জড়িত থাকুক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

তাছাড়া আটরশী খুনীদের সর্বোচ্ছ শাস্তির দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোব মিছিল অব্যাহত রয়েছে ।

Print Friendly, PDF & Email