এবি পার্টির ইফতারে রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের সম্মেলন
শিশুশ্রম প্রকল্পের ৬৮ কোটি টাকা লাপাত্তা
নিাজস্ব প্রতিবেদকঃ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন (৩য় পর্যায়) প্রকল্পে বড় ধরনের নয়ছয় হয়েছে। পুরো প্রকল্পের এনজিও নির্বাচনে ভুঁইফোড় সংগঠনকে নিয়োগ, যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম করে প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ৬৮ কোটি টাকার পুরো ব্যয়ে নানাধরনের অসঙ্গতি, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রত্যাহার ও দূরীকরণের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থা মন্ত্রণালয়ের নেয়া প্রকল্পে এ লুটপাট হয়।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরো প্রকল্পের বড় বড় ধাপগুলোতে চরম অস্বচ্ছতা ও অনিয়ম হয়েছে। প্রকল্পের বড় অংশ ছিল প্রচারণা ও সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম।
এ কার্যক্রমে প্রকল্পের ৮০ ভাগ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু প্রচারণার দায়িত্ব থাকা এনজিও নিয়োগ দেয়া হয় ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোকে। এনজিও নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে না জানিয়ে নিজেদের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়। তথ্য সংগ্রহকালে বেশিরভাগ এনজিওর অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি আইএমইডি। প্রচার কাজে বরাদ্দকৃত ৮০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে না পারলেও নানা খাত দেখিয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে। পুরো প্রকল্পে সরকার, এনজিও, নিয়োগকারী, শিশু শ্রমিক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহের ব্যাপক সমন্বয়ের অভাব ছিল। যা প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও সুপারভিশন এবং মূল্যায়নে প্রচণ্ড ব্যাঘাত ঘটে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়মিত যোগাযোগ, ফলোআপ ও মনিটরিং ব্যবস্থা ছিল দুর্বল। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জমা দেয়া আইএমইডির এক প্রতিবেদনে এ প্রকল্পের লুটপাটের চিত্র উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখের বেশি। এদের মধ্যে ১৭ লাখ শিশু কোনো না কোনো ভাবে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। যার একটি সিংহভাগ অর্থাৎ ১ লাখ ২১ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন ওয়েল্ডিং ও মোটর ওয়ার্কশপ, যানবাহনের হেলপার, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা, বিড়ি কারখানা, নির্মাণ কাজ- ইটভাটা-পাথর ভাঙা, অটোমোবাইল স্টেশন, ব্যাটারি রিচার্জিং স্টেশন, বর্জ্য অপসারণ, চামড়ার কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের কাজে জড়িত। পর্যায়ক্রমে এ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূর করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন (৩য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প নেয়া হয়, যা ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। দেশের ৭টি বিভাগের ১৪টি জেলার সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। এই প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন এবং স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টর থেকে শিশুশ্রম প্রত্যাহার। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দুর্বলতা ও দুর্নীতির এসব বিষয় উঠে এসেছে। সমীক্ষায় ৫০৮ জন শ্রমজীবী শিশু, ৬২ জন অভিভাবক, ৪৫ জন মালিকপক্ষ ও নিয়োগকর্তা, ৬৬ জন সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। আর ১০টি কেস স্টাডি ও ১৪টি এফজিডি করা হয়েছে; ১৪টি উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র ও ১৪টি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শন করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার (জিওবি) এর অর্থায়নে বাস্তবায়িত।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের জনবল নিয়োগ, সহযোগী এনজিও নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মসূচি বিশেষ করে মোটরসাইকেল, ফটোকপি মেশিন, কম্পিউটার ইত্যাদির মূল্য বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে। প্রকল্পের দুর্বল দিক তুলে ধরে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ শেষে পরবর্তী ফলোআপের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এসব শিশুদের উন্নত শ্রমবাজারে প্রবেশ বা উন্নত বিকল্প কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যোগসূত্র স্থাপনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা বিকল্প কর্মসংস্থান বা উন্নত শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। প্রকল্পে ৬ মাসের দক্ষতা বিষয়ক যে প্রশিক্ষণ রাখা হয়েছে তা ছিল খুবই অপ্রতুল। এছাড়া কোনো নির্দিষ্ট শিল্প কারখানার প্রয়োজনের ভিত্তিতে এবং শিশুদের চাহিদাভিত্তিক ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রকল্পে ডিজাইন করা হয়নি। আর প্রশিক্ষণের সহায়ক হিসেবে যেসব যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জামাদি কেনা হয়েছে তা ছিল খুবই নিম্নমানের। ফলে এসব উপকরণ কোনো কাজে আসেনি। আর এনজিওগুলো চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। আর প্রকল্পের মেয়াদ কম বিধায় শিশুদের সঠিক ও সম্পূর্ণ শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া যায়নি যা প্রকল্পের সফলতাকে ব্যাহত করেছে। তবে প্রকল্পের ভালো দিকও ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা শিশুরা উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আগের চেয়ে বর্তমানে ভালো কাজ করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে কাজ করতে পারে, তারা বর্তমানে পড়তে ও লিখতে পারে, হিসাব-নিকাশ করতে পারে, বর্তমানে তারা স্কুলে যায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। আর ৫৩ শতাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম হতে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করার চিন্তা করেছে। আর ৬২ শতাংশ মালিকপক্ষ এবং ৫২ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন যে, পূর্বের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগের হার বর্তমানে কমেছে।