আইটিডি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৭ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন
ডাক্তার, রোগী ও গণমাধ্যম
গোলাম মোর্তোজাঃ চিকিতসাসেবা ও ডাক্তার প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। রোগী, রোগীর পরিজন, বন্ধু কেউ খুশি নন ডাক্তার-হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে। প্রায় সব ডাক্তারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ। তীব্র অভিযোগ। মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে সংবাদ আসে, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, ডাক্তারের ভুল চিকিতসার।
বাস্তবতা কি আসলেও এমনই? হাসপাতালে কি কোনও চিকিতসাসেবা নেই? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ করা হয়, এর সবই কি সত্যি? অত্যন্ত স্পর্শকাতর এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের লেখা।
১. একজন খ্যাতিমান ডাক্তার। ডাক্তারিটা তার কাছে ধর্ম পালনের মতো পবিত্র। তিনি বললেন, ‘সম্প্রতি তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ প্রায় বিনাচিকিতসায় মারা গেলেন। কারণ কী জানেন?’ উত্তর না দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। নিজেই বলতে শুরু করলেন, ‘এই তিনজনের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ। কোনও হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হলেই রোগীর আত্মীয়স্বজন, পরিচিতরা অভিযোগ করেন, ডাক্তারের ভুল চিকিতসায় মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল ভাঙচুর করেন। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের জীবনশঙ্কা তৈরি হয়। গণমাধ্যম কোনও যাচাই-বাছাই না করে, রোগীর আত্মীয়-পরিজনের বক্তব্য ভিত্তি করে, ডাক্তার এবং হাসপাতালের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করে। ফলে এখন আর মানসম্পন্ন কোনও বেসরকারি হাসপাতালে পরিচিত রোগী ভর্তি করেন না। সিট নাই, অমুক হাসপাতালে নিয়ে যান ধরনের কথা বলে ফিরিয়ে দেন। এখানে-সেখানে নিতে নিতে রোগী বিনাচিকিতসায় মারা যান। সঠিক সময়ে চিকিতসা পেলে হয়ত তিনি বেঁচে যেতেন। আর হাসপাতালে ভর্তির পর মারা গেলে, আত্মীয়স্বজন ডাক্তারকে মারতে আসতেন, হাসপাতাল ভাঙচুর করতেন। আগে সব সিনিয়র ডাক্তারই হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় জরুরি বিভাগের ভেতর দিয়ে যেতেন। ক্রিটিক্যাল রোগী থাকলে, দেখে পরামর্শ দিয়ে যেতেন। এখন আর কেউ জরুরি বিভাগের কাছেও যান না। আমি দেখলাম রোগী তখন মারা গেল, দোষ আমার, হাসপাতাল ভাঙচুর। গণমাধ্যমে সেই সংবাদ ফলাও করে প্রচার হলো। আমার সারাজীবনের সেবা, অধ্যাবসায়ের কোনও মূল্য নেই। মুহূর্তেই আমি ভিলেন, আমি হত্যাকারী। ‘ কথাগুলো শুনে অনেকক্ষণ ভাবলাম। সবাইকে এভাবে ভিলেন বানিয়ে একটা জাতি এগুবে কী করে?
২. ঢাকা মেডিক্যাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের মতো হাসপাতালের নানা নেতিবাচক সংবাদ প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসে। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার সংবাদ মিথ্যা নয়। সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক। বেসরকারি বড় বড় হাসপাতাল যেমন ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, ল্যাবএইডের ব্যবস্থাপনাও পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়।
৩. কিন্তু ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা কি সত্যি? কতটা সত্যি? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে চিকিতসাসেবা না দেওয়ার যে ঢালাও অভিযোগ, তা ষোলোআনা সত্যি নয়। একেবারেই সত্যতা নেই তা বলছি না। বলছি অভিযোগের অনেকটাই অসত্য।
ঢাকা মেডিক্যাল, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এই তিনটি হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের যা ধারণ ক্ষমতা, চিকিতসাসেবা দেওয়ার যে ক্ষমতা, তার চার-পাঁচগুণ বেশি সেবা তারা দিয়ে থাকেন। ক্ষমতার চেয়ে চার পাঁচগুণ বেশি রোগীর চিকিতসা করতে হলে, প্রকৃত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
এসব ক্ষেত্রেও অধিকাংশ চিকিতসক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। একজন ডাক্তারকে যেহেতু অনেক বেশি রোগী দেখতে হয়, চুড়ান্ত অব্যবস্থাপনাপূর্ণ একটা পরিবেশে গিজগিজ করা রোগীদের চিকিতসা করতে গিয়ে ডাক্তারের ব্যবহারে অনেক সময় আন্তরিকতা থাকে না। অনেক ডাক্তারের ব্যবহারে সেবা নেওয়া রোগীরাও অসন্তুষ্ট হন। এই অসন্তুষ্টির সংবাদটিই গণমাধ্যমে আসে। ৪৫০ আসনের বিপরীতে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটকে যে ১৫০০ রোগীর সেবা দিতে হয়, সেই সংবাদ গণমাধ্যমে আসে না।
৪. হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদরোগের জন্যে অপরিহার্য রক্তের পরীক্ষাগুলো করা যায় না, নানা অব্যবস্থাপনার কারণে। এর জন্যে হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তাররা দায়ী নন। দায়ী তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আর হাসপাতাল পরিচালনকারী প্রশাসনের লোকজন—তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হাসপাতাল পরিচালনায় সেবাদানকারী ডাক্তারদের প্রায় কোনও ভূমিকা নেই। অথচ রোগীর যত অভিযোগ সব ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। এত কিছুর পরও হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলোর চেয়েও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি ডায়লাইসিসের দুটি মেশিনই যে নষ্ট, এর জন্য ডাক্তাররা দায়ী নন। দায়ী হাসপাতাল যারা পরিচালনা করেন, তারা। রোগীর আত্মীয়স্বজনের সব ক্ষোভ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। এই হাসপাতালটির অধিকাংশ ডাক্তার যে সারাদেশ থেকে আসা অসংখ্য রোগী প্রতিদিন দেখেন, তা প্রায় আলোচনায় আসে না। ঢাকা মেডিক্যালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দেশের কোনও হাসপাতাল যে সব রোগীদের ভর্তি নেয় না, তারা আসেন এসব হাসপাতালে। হার্ট ফাউন্ডেশন, কিডনি ফাউন্ডেশনসহ অনেক হাসপাতাল সামর্থ্যের চেয়ে বেশি মানুষকে সেবা দিচ্ছেন প্রতিদিন। বারডেম, ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল বিপুল সংখ্যক মানুষকে যে সেবা দিয়ে থাকে, তার প্রশংসা আমরা তেমন একটা করি না।
৫. রোগীর পেটে ব্যান্ডেজ রেখে সেলাই করে দেওয়াসহ নানা রকমের ভুল চিকিতসার সংবাদ মাঝেমধ্যেই জানা যায়। সংবাদগুলো মিথ্যা নয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে আমাদের এক বন্ধুর স্ত্রী সন্তান প্রসবের সময় মারা গেলেন। চিকিৎসক ছিলেন লায়লা আরজ্জুমান্দ বানু। আমাদের তখন মনে হচ্ছিল, চিকিতসার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন না। হয়তো আমাদের ধারণা ভুল ছিল। হয়তো তিনি সঠিক চিকিৎসাই করেছিলেন। কেউ ডাক্তারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেননি। কিন্তু রোগীর মৃত্যুর আগে এবং পরে ডাক্তার লায়লা আরজ্জুমান্দ বানুর সে দুর্ব্যবহার দেখেছিলাম, তা কোনওদিন ভোলা সম্ভব নয়।
৬. এমন চিত্রের বাইরেও তো চিত্র আছে। যেমন ডা. বরেন চক্রবর্তী। একজন দেবতুল্য ডাক্তার। ধর্ম পালনের মতো করে মনপ্রাণ দিয়ে রোগীর সেবা করেন। তার মতো একজন ডাক্তারকেও যখন আশঙ্কায় থাকতে হয়, রোগী মারা গেলে তার ওপর আক্রমণ হতে পারে, হতে পারে হাসপাতাল ভাঙচুর!
একজন ডাক্তার লুতফর রহমান। হৃদরোগ অপারেশনে তার সাফল্য কিংবদন্তিতুল্য। অনেক ক্রিটিক্যাল রোগী বিদেশে গিয়ে অপারেশন করতে পারেননি। মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকায় বিদেশের ডাক্তাররা অপারেশন করতে রাজি হননি। তেমন রোগী অপারেশন করে সুস্থ করে তুলেছেন ডাক্তার লুতফর। একজন রোগীর মৃত্যুর পর সেই ডাক্তার লুৎফরকেও বিপদের মুখে পড়তে হবে কেন?
হৃদরোগ অপারেশনে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, ইউরোপ সব জায়গায় রোগী মারা যায়। ডা. লুতফরের সাফল্যের হার অন্য যেকোনও দেশের ডাক্তারের চেয়ে কম নয়। তার মতো ডাক্তারের ক্ষেত্রে কেন শরীরিক আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হবে? ভুল চিকিতসার দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে কেন? রোগীর প্রতি ডা. লুতফরের দায়াবদ্ধতা-আন্তরিকতা নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবেন না। খুব সহজে যে কেউ তা জেনে নিতে পারেন।
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত যত রোগী দেখেন, তার বড় একটা অংশ দেখেন বিনা পয়সায়। এসব সংবাদ খুব একটা গণমাধ্যমে আসে না। নাক-কান-গলা চিকিতসায় নির্ভরতার প্রতীক প্রাণ গোপাল দত্ত। একজন ডা. সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের এত কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যেভাবে মানুষকে সেবা দেন, তার কোনও তুলনা হয় না।
যাদের নাম বলছি, তাদের বাইরে অনেক ভালো, মানবিক ডাক্তার আছেন সারাদেশে। বেশ কিছু খারাপ ডাক্তারের নাম বলতে পারবে, যারা অনৈতিক বাণিজ্য করছেন। কিন্তু তাদের তুলনায় ভালো ও নৈতিকতা সম্পন্ন ডাক্তারের সংখ্যা অনেক অনেক গুণ বেশি। আর সামগ্রিকভাবে খারাপ ডাক্তার-খারাপ মানুষ, এটা তো আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ফসল।
একটি কথা বলে রাখা দরকার, চিকিৎসা ব্যবস্থায় আগামী দিনে একটা ভয়ঙ্কর খারাপ সময় আসছে। যার জন্য দায়ী মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
৭. নায়ক মান্না মারা গিয়েছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। তার চিকিৎসক ছিলেন ডা. মোমেনুজ্জামান। আরেকজন গুণি ডাক্তার। মেধা, আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতা সব কিছুতেই অসাধারণ। মান্নার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাকেও অভিযুক্ত হতে হয়েছে। পরিবারের বক্তব্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যম তা প্রচার করেছে। অথচ সেই সময়ে মান্নার চিকিৎসা শুরু করার জন্যে পরিবারের সম্মতির যে প্রয়োজন ছিল, তা পাওয়া যায়নি। বিনা সম্মতিতে ডাক্তার চিকিৎসা দিতে পারেন না। বিশেষ করে অপারেশনবিষয়ক চিকিৎসা। পরিবারের সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হওয়া মান্না মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু সব দোষ পড়ল ডা. মোমেনুজ্জামানের ওপর। ডা. মোমেনুজ্জামানের দায়বদ্ধতা, আন্তরিকতা, মানবিকতার দিকটি কেউ দেখার প্রয়োজন মনে করলেন না।
প্রিয়জন মারা গেলে আত্মীয়স্বজন বিক্ষুব্ধ হতেই পারেন। কিন্তু গণমাধ্যম শুধু তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে একজন ডাক্তারের সুনাম ক্ষুণ্ন করে অপরাধী বানিয়ে দিতে পারে না।
৮. ডা. জাহাঙ্গীর কবীর একজন শতভাগ দায়বদ্ধ ডাক্তার। হৃদরোগ চিকিৎসায় অতুলনীয় সাফল্যের অধিকারী। নিজে অপারেশন করছেন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৈরি করছেন। আমরা যদি এসব মানুষকে ভুল ও অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করতে থাকি, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে! এমন অভিযোগে তাদের তো অভিযুক্ত হওয়ার কথা নয়। পুরো হাসপাতালের ব্যাবস্থাপনার ত্রুটির দায়ে তো তাকে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়।
৯. একথা সত্যি যে, বেসরকারি ব্যয়বহুল এসব হাসপাতালের সেবা, সব ক্ষেত্রে মানসম্মত নয়। রোগীর ‘পেস মেকার’ লাগানোর কথা বাম দিকে, ডাক্তার প্রথমে ডান দিকে লাগানোর চেষ্টা করেন—এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভুলও ইউনাইটেড হাসপাতাল করে। যা মানা যায় না। নারী রোগীকে যৌন হয়রানির অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন ব্যবস্থা নেয় না, ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করে, তা মানা যায় না। এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়া উচিত ।
১০. বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা মূলত ডায়াগনস্টিক নির্ভর। এই জায়গাটিতে বাংলাদেশে ভয়াবহ রকমের নৈরাজ্যকর অবস্থা। বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা বাংলাদেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। অধিকাংশ রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ওপর নির্ভর করা যায় না। মানসম্মত নয়। সবার বিরুদ্ধে নয়, অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা রোগীদের দিয়ে অপ্রয়োজনীয় টেস্টও করান। কমিশনের মতো একটি বিষয় বড়ভাবে আলোচনায় আসে। অনেক ডাক্তার ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ-বেশি দেখেন, সুবিধা নেন, এমন অভিযোগও আছে।
এসব অভিযোগের সবই সত্যি তা যেমন নয়, আবার সবই অসত্য তাও নয়। ভাবমূর্তি এবং ইমেজগত কারণে ডাক্তারদের এ ক্ষেত্রে কিছু একটা নিশ্চয়ই করার আছে। যদিও এই দায়ও সব ডাক্তারকে দেওয়া যাবে না।
ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসায়ী মালিকরা লাগাম ছাড়া। তাদের দেখবে, মনিটর করবে এমন কেউ নেই। যারা আছে, তারা সুবিধা নেওয়া ছাড়া কিছু করে না। একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষা যা কমিউনিটি হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় করা যায়, বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তা করতে হয় ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা দিয়ে। নিয়ন্ত্রণহীন স্বেচ্ছাচারিতা। তারপরও অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেস্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করা দরকার জনগণের পক্ষে। রাষ্ট্র জনগণের পক্ষে তা করে না, করে মালিকদের পক্ষে। কিন্তু মালিকদের অনৈতিক বাণিজ্য আর অব্যবস্থাপনার দায় নিতে হয় ডাক্তারদের। সরকারি হাসপাতালগুলোর দামি দামি মেশিন অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে। ফলে সামর্থ থাকুক বা না থাকুক, মানুষকে যেতে হয় ব্যয়বহুল হাসপাতালে।
১১. সারাদেশ তো বটেই বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোরও করুণ অবস্থা। সব মানুষকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হয়। হাসপাতালের খারাপ অবস্থার জন্য দায়ী পরিচালকরা, ডাক্তাররা নয়। ডাক্তাররা উপজেলা পর্যায়ে থাকেন না, নিয়োগ এবং ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির কারণে। এই দায় শুধু ডাক্তারদের ওপর চাপানো যাবে না। যন্ত্রপাতি কেনায় ডাক্তারদের ভূমিকা থাকে না, অথচ কেনাকাটার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়।
ডাক্তারদের একটা অংশ আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতি করেন। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম দুর্নীতি, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেন না। মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তাদের ভূমিকাও যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন জনমানুষের ক্ষোভ বাড়ে। সব ডাক্তার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। যদিও দায় নিতে হয় সব ডাক্তারদের।
১২. সব ডাক্তার খারাপ নয়। ভালো ডাক্তারের সংখ্যাই বেশি। ভয়ঙ্কর সমস্যা সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায়। যা দূর করা অপরিহার্য। ঢালাওভাবে সব ডাক্তারদের অভিযুক্ত করার মানসিকতা পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। শুধু অভিযুক্ত করার আত্মঘাতী নীতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার সবারই। বাংলাদেশের মানুষ যে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, তার কারণ সরকারগুলোর জনগণের প্রতি দায়াবদ্ধতার ঘাটতি। ডাক্তারদের ওপর সব দায় চাপানোর অর্থ সমস্যা পাশ কাটিয়ে যাওয়া।
একজন দেবি শেঠী ভারতের জাতীয় বীর। বরেণ চক্রবর্তী, লুৎফর রহমান, জাহাঙ্গীর কবীর, প্রাণ গোপাল দত্ত, সামন্ত লাল সেনরা আমাদের জাতীয় বীর। এমন আরও অনেক মানব সেবক জাতীয় বীর আছেন।
তাদেরকে আমরা চিনি না, জানি না। তবে জানা দরকার। তাদের সামনে এনে সম্মানিত করা দরকার। অন্যায় -অনিয়মের প্রতিবাদ করতে হবে, সত্য বলতে হবে, জাতীয় বীরদের সম্মানের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে। কয়েক জনের ভুল বা অন্যায়ের কারণে সবাইকে এক কাতারে ফেলা ঠিক নয়।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক