শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ : অমানিষার হাজার রজনী

002এম আবদুল্লাহঃ অমাবষ্যার রাত দীর্ঘ হয়। কিন্তু কত দীর্ঘ হতে পারে অমানিষা? প্রতি চন্দ্রমাসে অমাবষ্যার রাততো একটি। যদি প্রতিটি রাতই অমাবষ্যার রাত হয়? চাঁদের মুখ যদি দেখা না যায় হাজার রাতেও? সেতো নি:সন্দেহে এক দু:সহ-দুর্বিষহ পরিস্থিতি। ঘনঘোর অমানিষা ভুবনকে নিকষ কালো চাদরে ঢেকে দেয়, মানুষকে ডুবিয়ে দেয় ভীতি, অনিশ্চয়তা ও হতাশার অথৈ সাগরে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রাস হলে যেমন একটু চন্দ্র কিরণের প্রত্যাশায় প্রহর গুণে মানুষ, তেমনি হাজার রজনী ধরে প্রতীক্ষায় দৈনিক আমার দেশের হাজারো কর্মী ও অগনিত পাঠক। সময়ের সাহসী কলমযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান, তার পরিবার ও কোটি ভক্ত-অনুরাগী সহ¯্র রাত ধরে অপেক্ষায়-কখন ভোরের আলো উঁকি দেবে।
২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সতেরো মিনিটের কমান্ডো অভিযানে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার, আমার দেশ অফিস তছনছ আর ছাপাখানায় বলপূর্বক তালা ঝুলিয়ে দেয়ার হাজার কৃষঞ রজনী পার হলো। সেদিন ভোরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরার স্টাইলে পত্রিকা কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর হাজার দিন ধরে কারাগারে ধুঁকছেন নিরপরাধ অক’তভয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। পত্রিকা বন্ধ, সম্পাদক গ্রেফতার করেই থামেনি ওরা, কাওরান বাজারের পত্রিকা অফিস আগুনে পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে ঠিকানাহীন করে দেয় এক জাঁক নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মীকে। অদম্য সাহসে ভর করে সত্য প্রকাশ ও ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষুর কাছে মাথা না নোয়াবার অপরাধে একজন পত্রিকা সম্পাদককে কতটা মূল্য দিতে হয় তা অবাক বিস্ময়ে দেখছে গোটা বিশ্ব। আর মাহমুদুর রহমানের নির্ভীক ও হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি এবং বিপ্লবী মুষ্টিবদ্ধ হাতের অঙ্গীকার যে প্রেরণা যুগিয়েছে, তা অবলম্বন করেই পৌনে তিন বছর ধরে বেকারত্বের দু:সহ ঘানি টানছে আমার দেশ পরিবারের সদস্যরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে অসম সাহসী কলমযোদ্ধা, ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর আতঙ্ক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের দ্বিতীয় দফায় বিনাবিচারে কারাবন্দিত্বের এক হাজার দিন পূর্ণ হলো আজ। একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক গণমানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধেরও সহ¯্র দিন পার হয়েছে। মাহমুদুর রহমনাকে গ্রেফতারের পর নানা বানোয়াট ও হাস্যকর মামলায় একের পর এক রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর চালানো হয় বর্বরোচিত নির্যাতন। বিপন্ন করে তোলা হয়েছে তার জীবন। দু’দফায় সাড়ে তিন বছরের বেশী কারাবন্দী থেকে মাহমুদুর রহমানের শারিরীক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। সততা ও দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান দুর্দান্ত সাহসী মানুষটি আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম দফায় ২০১০ সালে দুর্নীতির সাড়া জাগানো খবর প্রকাশ করে এবং দ্বিতীয় দফায় শাহবাগি নাস্তিকদের মুখোশ উন্মোচন করে ফ্যাসিবাদী সরকারের রোষানলে পড়েন নির্ভীক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারি স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর থেকেই মাহমুদুর রহমানকে দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতারের হুমকি আসে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। চার মাসেরও বেশি সময় তিনি আমার দেশ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করেন। এরপর কথিত গণজাগরণ মঞ্চ থেকে দেশপ্রেমিক গণমাধ্যম বন্ধের হুঙ্কার এবং মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ফ্যাসীবাদী দাবি তোলা হয়। সরকার শাহবাগি নাস্তিকদের দাবি পূরণে শেষ পর্যন্ত বিনাঅপরাধে একজন মানবতাবাদী কলমসৈনিককে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে। গ্রেফতারের পর এক হাজার দিন অতিক্রান্ত হলেও তার বিরুদ্ধে সুুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কিংবা তদন্ত পরিচালনা করে রিপোর্ট দিতে পারেনি পুলিশ। দুদকের নোটিশের জবাব না দেয়ার একটি ঠুনকো মামলায় তাকে নজীরবিহীনভাবে জেল-জরিমানা করা হলেও তা অনেক আগেই কারাবাসের সময়ের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে গেছে।
প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী পুত্র জয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশের জেরে ২০১০ সালের ১ জুন পত্রিকা কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে ১০ মাস ১৭ দিন কারাবন্দি রাখা হয় মাহমুদুর রহমানকে। পত্রিকাটিও সে সময় ৪৭ দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে আদালতের আদেশে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও অপশাসনের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করায় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট ৬৮টি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হছে।
একজন পত্রিকা সম্পাদককে যেভাবে দাগী সন্ত্রাসীর মত ধরে নিয়ে গিয়ে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তা বাংলাদেশে শুধু নয় গোটা বিশ্বে নজীরবিহীন। ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সকালে মাহমুদুর রহমানকে পত্রিকার কার্যালয় থেকে গ্রেফতারে ঘটনাটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। ওই দিন ভোর ৮টা ৫১ মিনিট থেকে ৯টা ৮ মিনিট পর্যন্ত ১৭ মিনিটের কমান্ডো স্টাইলের অভিযানে তাকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। হঠাৎ ডিবি, র‌্যাব ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকশ’ সদস্য কারওয়ান বাজারে অবস্থিত আমার দেশ পত্রিকা কার্যালয় ঘিরে ফেলে। সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে ডিবি পুলিশের অর্ধশতাধিক সদস্য কার্যালয়ের ১১ তলার গেটে অবস্থান নেয়। সেখানে গার্ডকে মারপিট করে চাবি কেড়ে নেন তারা। কমান্ডো স্টাইলে সরাসরি সম্পাদকের কক্ষে যান ডিবি সদস্যরা। মাহমুদুর রহমান তখন চা খাচ্ছিলেন। পুলিশ তাকে চা খাওয়া শেষ করতেও দেয়নি। দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে মাহমুদুর রহমানকে কার্যালয় থেকে বের করা হয়। কেবল লুঙ্গি বদলে পায়জামা পরার সুযোগ দেয়া হয় তাকে। গ্রেফতারকালে তিনি একটি পবিত্র কোরআন শরিফ সঙ্গে নিতে চেয়ে পারেননি। গ্রেফতারের পর সম্পাদকের কক্ষে তল্লাশির নামে জিনিসপত্র তছনছ করে ডিবি পুলিশ। তারা মাহমুদুর রহমানের ব্যক্তিগত কম্পিউটার, সিসি ক্যামেরা, পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ নথিসংবলিত সাতটি সিডি ও কিছু কাগজপত্র নিয়ে যায়।
মাহমুদুর রহমানকে গ্রেতারের পর ওইদিনই রাত ৯টার দিকে একদল পুলিশ তেজগাঁওয়ে আমার দেশ প্রেসে অবস্থান নেয়। তারা প্রেসে কর্মরতদের বের করে দেয়। এ সময় পুলিশ ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়নি। পুলিশ কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই জবরদস্তিমূলকভাবে আমার দেশ-এর প্রেস সিলগালা করে দেয়। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় জেলা প্রশাসককে অবহিত করে দৈনিক সংগ্রাম-এর ছাপাখানা আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে পত্রিকা ছাপানো হয়। সেখানে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা ছাপানোর অভিযোগে ১৩ এপ্রিল শনিবার রাতে অভিযান চালায় পুলিশ। একজন মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এখানে পুলিশ ৬ হাজার ১ কপি পত্রিকা জব্দ করে। পুলিশ পত্রিকা জব্দের পাশাপাশি ছাপার প্লেট খুলে নেয় এবং আমার দেশ-এর ছাপা সংশ্লিষ্ট ১৯ জন কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায়। মামলা দেয়া হয় দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ ও আমার দেশ পাবলিকেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে। মাহমুদা বেগম আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মা। মাহমুদুর রহমান গ্রেফতারের পর তিনি পাবলিকেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১১ এপ্রিল গ্রেফতারের পর মাহমুদুর রহমানকে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কথোপকথন কেলেঙ্কারি ফাঁসের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলায় দশ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত সাত দিন মঞ্জুর করে। একই থানায় দায়ের করা আরো দুটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিন করে ১৪ দিন রিমান্ড চাইলে আদালত তিন দিন করে ছয় দিন মঞ্জুর করে। এ দুই মামলার এজাহারে তার নাম ছিল না। এমনকি মামলায় পুলিশি কাজে বাধাদান ও মারধরের যে তারিখ ও সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আমার দেশ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। এ সময় তাকে গ্রেফতার করার ঘোষণা দেন কয়েকজন মন্ত্রী। ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি উচ্চ আদালতে গেলেও জামিন পাননি। এমনকি তাকে গুম করার গুজবও ওঠে। ওই পরিস্থিতিতে ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে মাহমুদুর রহমান প্রায় চার মাস পত্রিকা কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন।
২০১৩ থেকে ২০১৬। হাজার রজনী পার করেও আমার দেশ পরিবারের সামনে গাঢ় অন্ধকার আর অনিশ্চয়তা। আইনী নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও পত্রিকাটি কবে পুন:প্রকাশ হবে তা কেউ জানে না। অনেকে পেশা ছেড়ে নিদারুন কষ্টের দিন কাটাচ্ছেন। অনেকের সন্তানের লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমার দেশ ছাড়াও বহু গণমাধ্যম বন্ধ কিংবা সংকুচিত হওয়ায় শত শত সাংবাদিক বেকার। সরকার ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ শাসন করছে। দেশে গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই সরকার শুধু আমার দেশ বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি। দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করেেেছ। সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন বিএফইউজে’র নির্বাচিত সভাপতি শওকত মাহমুদকে বিনা ওয়ারেন্টে ধরে নিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ডে নির্যাতন ও প্রায় ৫ মাস ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। ইনকিলাব বন্ধ করেছে দু’দফায়। পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবি, সিনিয়র সাংবাদিক রফিক মুহাম্মদ ও আতিককে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালিয়েছে। জ্যেষ্ঠ সম্পাদক আবুল আসাদকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। শীর্ষনিউজ সম্পাদক একরামুল হককে বানোয়াট গ্রেফতার-নির্যাতন করা হয়েছে। ইটিভি চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে কারাবন্দী করে টিভি স্টেশনটি দখল করেছে। ইটিভি সাংবাদিক ড. কনক সরওয়ারকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীসহ এ পর্যন্ত ২৭ জন সাংবাদিক এর সরকারের সময় খুন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় যায়, তখন গণমাধ্যমে হামলা করে। ’৭৫-এ সব সংবাদপত্র বন্ধ করেছিল। তারও আগে মওলানা ভাসানীর হক কথা বন্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এলেই তাদের প্রথম কাজ পত্রিকা বন্ধ করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানুষের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা। মানুষকে সত্য কথা বলতে দেয় না। বর্তমানে অধিকাংশ সংবাদপত্রের মালিকানাই তাদের। তবুও একটুখানি সমালোচনা সহ্য করছে না। রক্তচক্ষুর সামনে সব গণমাধ্যম অসহায় আত্মসমর্পন করেছে। মাহমুদুর রহমানকে যদি মুক্ত করা না যায়, আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ বন্ধ গণমাধ্যম যদি খোলানো সম্ভব না হয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের আরও কঠিন বিপর্যয় আরও নির্মম পরিনতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।