আইটিডি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৭ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন
“তারা ‘মানব’ নয়, তাদের আবার ‘মত’ কিসের?”
ফরহাদ মজহার ▪ ভয়ংকর হত্যার ঘটনায় আমরা বিহ্বল হয়ে যাই। কিছুটা হুঁশ হলে বলি, ‘আমার মর্মাহত, আমরা দুঃখিত, আমরা শোকার্ত’, ইত্যাদি। কিম্বা কথাগুলো হয়তো আমাদের বলতেই হয়। ধরে নিন, এইসব ফর্মাল শোক আমি প্রকাশ করছি।
ব্রান্টন টারান্টের বয়স মাত্র ২৮ বছর। অস্ট্রেলিয়ার আল নূর মসজিদে নামাজিদের ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার দৃশ্য সে সরাসরি লাইভ প্রচার করছিলো। ডিজিটাল টেকনলজির কৃপা! এর জন্য বেশ শক্ত নার্ভের দরকার হয়। একে নিছকই ঘৃণা বা মুসলমান বিদ্বেষ বলে পরিসমাপ্তি টানা যায় না। নিজেদের আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি, ইরাকে, পাকিস্তানে কিম্বা অন্যত্র মুসল্লিদের মসজিদে বোমা মেরে হত্যার ঘটনা কি ঘটেনি? ঘটেছে। ভারতে গোরক্ষার অজুহাতে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে; ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে সবসময়ই বাংলাদেশীদের গরু পাচারকারী অভিযোগে গুলি করে হত্যা করা হয়। কারণ গরু যারা পূজা করে না এবং গোমাংস খায়, আর যাই হোক তারা মানুষের বাচ্চা না।
ইসলামোফোবিয়া অর্থাৎ ইসলাম আতংক ও বিদ্বেষ বাস্তব। কিন্তু এর দ্বারা আমরা ঠাণ্ডা মাথায় ‘অপর’কে হত্যার ঘটনা পুরাপুরি বুঝব না। আমাদের নিজেদের মতোই দেখতে আরেক মানুষকে ’অপর’ ভাবা অনেক গভীর একটা প্রক্রিয়া, যার সঙ্গে বিশ্বাস, মতাদর্শ, ইতিহাস, সমাজ, শিক্ষা সবকিছুই নানান ভাবে জড়িত।
খেয়াল করুন, ব্রান্টন টেরেন্ট একজন ‘আদর্শবাদী’ হত্যাকারী। টুইটারে সে তার ‘ম্যানিফেস্টো’ বা ইশতেহার আগেই সবাইকে প্রচার করেছে। সেখানে সে তার ‘আদর্শ’ই প্রচার করেছে। তাহলে বলা যায়, যতোই জঘন্য হোক, আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যই এই হত্যাকাণ্ড। তাহলে আদর্শ আর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সম্পর্ক কী? দুনিয়ায় যেসব যুদ্ধবিগ্রহ খুনাখুনি হয়েছে তা কি কোন না কোন আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ঘটে নি? দুনিয়ায় যতো মানুষ নিহত হয়েছে তাদের কি কোন না কোন আদর্শের বেদিতে বলী দেওয়া হয় নি?
এরপর রয়েছে অপরায়নের প্রক্রিয়া। যাকে আমরা ‘অপর’ জ্ঞান করি, আমাদের মতো ‘মানুষ’ গণ্য করি না, তাদের হত্যার মধ্যে কোন অস্বস্তি বোধ থাকে না, কিম্বা কোন ন্যায়-অন্যায় বোধও নয়। এটা অনেক গভীর অসুখ । বাংলাদেশে দেখছি শিক্ষিত সেকুলার ভদ্রলোক শ্রেণী, যারা আন্তর্জাতিক ভাবে মানবাধিকার কর্মী হিশাবে প্রতিষ্ঠিত, তারা টুপি-কোর্তা পরা মাদ্রাসার ছেলেদের ‘মানবাধিকার’ আছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে — এটা বিশ্বাস করে না। কারণ তারা মৌলবাদী এবং জঙ্গী। মৌলবাদী ও জঙ্গীদের ‘মানবাধিকার’ থাকতে পারে না। কারন তারা ‘মানব’ নয়, তাদের আবার ‘মত’ কীসের?
ব্রান্টনকে ‘মানসিক রোগী’ প্রমাণ করা কঠিন, কারন তারা সবাই মিলে চারজন। তিনজন পুরুষ এবং একজন নারী। তারা একটা ‘আদর্শ’ বাস্তবায়নের জন্যই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সেটা ভাল পদ্ধতি কিনা তর্ক সাপেক্ষ বটে, কিন্তু ‘আদর্শ’ নামক ভূত ইতিহাসে দানবীয় রূপ পরিগ্রহণ করেছে তার বিস্তর নজির আছে।
নিউজিল্যান্ডের ঘটনা আমাদের মর্মাহত করেছে এতে সন্দেহ নাই। যাঁরা মারা গিয়েছেন আল্লাহ তাঁদের জান্নাত কবুল করুন। তাঁদের পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে আমাদের অশ্রু এবং মোনাজাত মজুদ রইলো। কিন্তু আমরা যেন ঘটনার বাহ্যিক কোলাহল এড়িয়ে আরও গভীর ভাবে ভাবতে শিখি।