আইটিডি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৭ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন
সংবাদ বিশ্লেষণ
আল্লামা আহমদ শফি ও জুনায়েদ বাবুনগরীকে মুখোমুখি করা হচ্ছে কেন?
সৈয়দ শামছুল হুদা ♦
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আমাদের প্রানপ্রিয় সংগঠন। এর মাধ্যমে সারাবিশ্বকে আমাদের শক্তির জায়গাটা জানান দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ইসলামী রাজনীতির নামে সাধারণত: বাংলাদেশের আলেমগণ যে রাজনৈতিক দর্শন লালন করেন তাতে অনেক তর্জন, গর্জনকারীদের সাথে নিয়ে হলেও মানানসই সংগঠন হলো হেফাজত। কওমী মাদ্রাসার অনেক মুহতামিম বা শিক্ষক আছেন নিবন্ধিত রাজনীতির সাথে জড়িত। আসলে তারা কেহই পেশাদার রাজনীতিবিদ না। তা করতে তারা ইচ্ছুকও না। সামর্থও রাখেন না। মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে এদেশের গণমানুষের রাজনীতি করাও সম্ভব নয়। যে কারণে এদেশের ইসলামী রাজনীতির সাথে আপামর জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। জনগণের মধ্যে আশা-আকাঙ্খা তৈরীতে এসব দলের তেমন কোন ভূমিকাও নেই। আলেমদের মেজাজ ও রাজনীতির সাথে হেফাজতে ইসলাম এর রাজনীতিই যথেষ্ট মানানসই। মৌসুমী রাজনীতিতে আমরা অভ্যস্ত। বিধায় একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এর সাথে সকলে মিলে জড়িয়ে থাকাই নিরাপদ।
হেফাজত এমন এক ধরণের সংগঠন যেখানে কেউ বড় বড় হুঙ্কার দিয়ে ঘরে বসে থাকলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ এখানে এতবেশি জনশক্তি রয়েছে, দুয়েকজন নিজেদের আড়াল করে নিলেও কোন সমস্যা নেই। এই সংগঠনের মূল বক্তব্যই হলো, আমরা কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আন্দোলন করি না, কাউকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়ার জন্যও আন্দোলন করি না। বরং আমাদের মূল কাজ হলো : ঈমান ও ইসলামের যে কোন বিষয়ের সুরক্ষার জন্য কাজ করা। এই সংগঠনের মাধ্যমে দেশের সকল শ্রেনি পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখার বড় একটা সুযোগ রয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে এ ধরণের সংগঠনের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহও রয়েছে। দেশের সরকারসহ যে কোন দেশি-বিদেশি শক্তি যারাই দেশ ও জাতির স্বার্থ নিয়ে কোন প্রকার ষড়যন্ত্র করবে, তাদের রুঁখে দেওয়ার জন্য এ ধরণের সংগঠনের কোন বিকল্প নেই। হেফাজতকে যদি সুন্দরভাবে সবাইকে নিয়ে নতুন করে পুর্নগঠন করা যায়, তাহলে অনেক শক্তিশালী সংগঠনে রুপান্তরিত হবে ইনশাআল্লাহ। রাজনীতির বাইরে ও রাজনীতি চলে। হেফাজত সেই রাজনীতিটাই করবে। যাতে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ে কেউ কোন ধরণের গেইম খেলার সাহস না পায়।
হেফাজতকে সাময়িক সময়ের জন্য দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। এই দমিয়ে রাখার মধ্যেই মূল রহস্য রয়েছে হাটহাজারী মাদ্রাসাকে নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনার। হেফাজতের মতো সংগঠনের শক্তি কতটা তা এই সরকার খুব ভালো করেই জানে। জানে শাহবাগের সেই নাস্তিক ও তাদের পৃষ্টপোষকরাও। ২০১৩ সালে শাহবাগে জাগরণের যে ঢেউ তোলা হয়েছিল তা যদি হেফাজত রুঁখে দিতে না পারতো, এতদিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেহারা আরো ভিন্ন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। দেশের সহজ ও সরলপ্রাণ কিছু নিরীহ আলেম-উলামা, সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে বড় বিপদের প্রাথমিক ঝড়টা বয়ে গেছে। যারা বেঁচে গেছে মুখে স্বীকার না করলেও বুঝতে পারছে যে, সেদিন যদি হেফাজত এভাবে বুক টান করে রাস্তায় না দাঁড়াতো তাহলে এদেশের অনেক ইসলামী রাজনীতির চিত্র আরো করুনভাবে ভিন্ন হয়ে যেতো। আরো অনেক জাতিয়তাবাদির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতো। হেফাজতের প্রতি পরোক্ষভাবে কৃতজ্ঞ সকল শক্তি। যদিও তারা মুখে হেফাজতের কথা বলবে না। কিন্তু আমরা সেটা বুঝি।
আজকে হাটহাজারী মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বারবার কেন ঝড় উঠছে? কেন আল্লামা আহমদ শফী দা.বা.কে দিয়ে এমন অসুস্থ শরীর নিয়েও ভিডিওতে জবাব দিতে বাধ্য করা হচ্ছেন? কেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়ে নানা মহল থেকে নানা রহস্যজনক মন্তব্য করা হচ্ছে? কেন আল্লামা আহমদ শফী ও জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা. মহোদয়দেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে? আল্লামা বাবুনগরীকে নিয়ে কেন এত অস্থিরতা? এর সবকিছুর মূলে রয়েছে আগামী দিনে হেফাজতের লাগাম টেনে ধরা।
হেফাজতের অন্যতম একটি ধারা হলো, যিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান হবেন, তিনিই হবেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর। এই ধারার মধ্যেই যত সমস্যা। যত অস্থিরতা। আজকে যারা ২০১৩ সাল থেকে সরকারের সাথে গভীর ঘনিষ্টতা নিয়ে বুক ফুলিয়ে চলছেন, কোনভাবে যদি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা. হাটাহাজারী মাদ্রাসার দায়িত্বে চলে আসেন, তাহলে এই খেলা হয়তো বা আর চালানো সম্ভব হবে না। মাওলানা আনাস মাদানী সাহেব এই প্যাচেই পড়েছেন। ঢাকার কিছু শক্তিশালী আলেম-উলামা সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. এর বয়সজনিত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত হেফাজতকে পকেটস্থ করে রেখেছেন। আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. খুব বেশিদিন হয়তো বাঁচবেন না এটা বুঝতে পেরে অনেকে এখনই অস্থির হয়ে উঠেছেন। জনাব আনাস মাদানী সাহেব এর মাধ্যমে হেফাজতের যে কোন কঠোর কর্মসূচীকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়েছে হয়তো আগামী দিনে এটা সম্ভব নাও হতে পারে। আর এ আতঙ্ক থেকে হাটহাজারী নিয়ে এখন শুধু হাটহাজারীতেই ভাবা হয় না। ভাবা হয় অনেক দূর থেকে। অনেক শক্তিশারী জায়গা থেকে।
হেফাজতের সাথে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর যে ঘনিষ্টতা, সারা বাংলাদেশের আলেমদের সাথে হেফাজত ইস্যুতে যেভাবে আল্লামা বাবুনগরীর সম্পৃক্ততা তৈরী হয়েছে এটা হাটহাজারীর আর কোন উস্তাদের নেই। ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম বা পরবর্তী মুহতামিম হিসেবে কোন অবস্থাতেই আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে হাটহাজারীতে দেখতে চায় না গত ৭বছর ধরে সুবিধা পাওয়া আলেমদের একটি শ্রেণি। সাথে রয়েছে সরকার।
সুতরাং হাটহাজারী উলামা পরিষদ যখন হাটাহাজারী মসজিদে বসে জোরালো প্রতিবাদ করেন তাকে যেমন ফালতু কাজ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. এর ভিডিও দেখেই সব সন্দেহ থেকে একেবারে মুক্ত থাকার কোন সুযোগ নেই। এটা কে না জানে যে, আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. এখন যে অবস্থায় রয়েছেন সে জায়গা থেকে সব সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেওয়ার অবস্থায় নেই। অন্তত নানা পারিপার্শ্বিক সবকিছু জানার সুযোগ হুজুরের এখন নেই। উনার খুব কাছে যারা থাকেন, উনারা হুজুরকে যেভাবে যে বিষয়টি ব্রিফ করবেন হুজুর এর বিপরীতটা জানার কোন সুযোগ নেই। এখানেই চলছে রাজনীতির খেলা। আর হুজুর হলেন আল্লাহওয়ালা। বুযুর্গব্যক্তি। রাজনীতির নোংরামি বুঝে সবকিছু করার অবস্থায় হুজুর নেই এটা মেনে নেওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। বরং উল্টো দাবী করাটাই মনে হয় বেইনসাফি হবে।
এই সংকটের শুরু ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল থেকে। সেদিন শাপলা চত্বরের মহাজাগরণে আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. বয়সের কারণে যখন মূল বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারছিলেন না, সেদিন যদি সেই বক্তব্যটা আনাস মাদানী সাহেবকে না দিয়ে উনার পরের আর যে কোন সিনিয়র আলেমকে দিয়ে সেদিনের সমাপনী বক্তব্যটা দেওয়ানো যেতো তাহলে এতটা সমস্যা হতো না। যে কোন জাগরণে প্রধানের বক্তব্যটাই থাকে মুখ্য। সেদিন হুজুর পারছিলেন না, ঠিক আছে, তার পরিবর্তে যদি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা. বা নূর হোসাইন কাসেমী দা.বা. বা মাওলানা আশরাফ আলী দাবা. প্রমুখদের কেউ বক্তব্যটা উপস্থাপন করতেন তাহলে খুব ভালো হতো। সেদিন থেকেই জনাব মাওলানা আনাস মাদানী সাহেব লাইমলাইটে চলে আসেন।সরকারের বিশেষ বাহিনীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেন তিনি। সরকার এ সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে।
আসুন, আমরা এসব বিষয়কে রাজনীতির ভিতর দিয়েই চিন্তা করি। এত সহজ সরলীকরণের জায়গা থেকে চিন্তা করলে ৬ মে’র পরের অবস্থার মতো আবারও পস্তাতে হবে। হাটহাজারী এখন আর শুধু হাটহাজারী মাদ্রাসাই না, এটা আগামী দিনের বাংলাদেশকে রক্ষার মূল সূতিকাগার। এদেশের সাধারণ মানুষ ও তৌহিদী জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার অন্যতম জায়গা হলো এই হাটহাজারী। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হেফাজত করুন। দেশকে হেফাজত করুন। হাটহাজারীকে হেফাজত করুন। আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা উভয়ের শান ও মান হেফাজত করুন। তৌহিদী জনতাকে কষ্ট দেয় এমন যে কোন অপতৎপরতাকে শক্ত হাতে রুঁখে দেওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক ঃ জেনারেল সেক্রেটারী, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম)। ১৮.০৫.২০২০
সূত্রঃ ফেসবুক টাইমলাইন