ইন্টারনেটের ছোঁয়ায় বদলে গেলো জীবন

চীনের উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত সিনচিয়াংয়ের একটি গ্রাম। নাম তার আকসুপা। প্রাচীন সিল্ক রোডের একটি আউটপোস্ট ছিল একদা এই গ্রাম। রাজধানী ও অন্যান্য বড় শহর-নগর থেকে বহু দূরে এটি। তাই উন্নয়নের ছোঁয়া বলতে গেলে লাগেইনি এই গাঁয়ে। কিন্তু ইন্টারনেটের ছোঁয়ায় আজ বদলে গেছে সেই নিঝুম গাঁয়ের চিত্র। কিভাবে? সে গল্পই লিখেছে চীনের চায়না ডেইলি পত্রিকা।
একে তো রুক্ষ পাহাড়ি জমি, ফসল ফলে খুবই সীমিত, তার ওপর দেশের একেবারে প্রান্তে অবস্থান- সব মিলিয়ে দারিদ্র্যই ছিল এখানকার অনিবার্য নিয়তি। ২০১৩ সালে নেমে এলো আরেক বিপদ। ফসল যা ফলতো, সেবার হ্যারিকেন সব উড়িয়ে নিয়ে গেলো। এতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার একেবারে নিচে নেমে গেলো।
কিন্তু এর মধ্যেও সম্ভাবনার আলো দেখতে পেলেন গ্রাম প্রধান ঝু রেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য, যেমন হাতে তৈরি রুটি, ডিম, মধু এসবের ভালো ব্যবসায়িক সম্ভাবনা রয়েছে। আর ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়েই পণ্যগুলো হাজার হাজার মাইল দূরের শহর-নগরে পাঠানো যায়।
এভাবেই শুরু। এখন এখানকার হাতে বানানো এবং বেশ কয়েক দিন ভালো থাকে এমন রুটি বিমানে করে চলে যাচ্ছে রাজধানী পেইচিংইয়েংর ভোক্তাদের খাবার টেবিলে।
আকসুপা গ্রামের বাসিন্দা আওয়াহান ওসমান (৪৯) একজন দক্ষ রুটি প্রস্তুত কারক। এই নারী প্রতি মাসে তৈরি করেন তিন হাজারেরও বেশি রুটি। সেসব রুটি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তিনি জানান, দুই বছর আগেও তিনি এর মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ রুটি বিক্রি করতেন।
আওয়াহানের স্বামী ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। পাঁচ বছর আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। পরিবারটি এতে দিশেহারা হয়ে যায়। আর এখন সিনচিয়াংয়ের জনপ্রিয় ‘নাং’ রুটি সারা দেশে সাপ্লাই দিয়ে আওয়াহান মাসে উপার্জন করেন দুই থেকে তিন হাজার ইউয়ান। তিনি গর্বের সুরে বলেন, আগে আমার রুটি বিক্রি হতো শুধু আমাদের গ্রামে, আর এখন পেইচিং ও শাংহাইর মতো বড় বড় শহরেও আমার রুটি যায়।
তার এই সাফল্যের গোপন কথা জানতে চাইলে এই উইঘুর মুসলিম নারী, যিনি চীনা ও ইংরেজি কোনো ভাষাই জানেন না, শুধু একটি ইংরেজি শব্দ বলেন- ইন্টারনেট।
উইঘুর ভাষায় এখন অনেক ইংরেজি শব্দ ঢুকে পড়েছে। যেমন, ইন্টারনেট, কমপিউটার, টেলিফোন ইত্যাদি। আর দারিদ্র্য দমনের নতুন অস্ত্র হিসেবে আকসুপা গ্রামে ইন্টারনেট শব্দটি খুবই জনপ্রিয়।
২০১৪ সাল থেকেই গ্রামবাসীর উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে বিক্রি করতে থাকে স্থানীয় সরকার। প্রথম প্রথম আয় হতো খুব কম, কিন্তু এখন প্রক্রিয়াটি দাঁড়িয়ে গেছে এবং গ্রামের অনেক গরিব পরিবারের আয়ের প্রধান উৎসই এটি।
গ্রামপ্রধান ঝু রেন বলেন, আমাদের গ্রামে দূষণ বলতে গেলে নেইই, আর এরকম অরগানিক পণ্যই শহরবাসীর পছন্দ।
গ্রামের অনলাইন স্টোরটি এ বছর ১০ হাজারের বেশি ডিম বিক্রি করে ১৫ হাজার ইউয়ান আয় করেছে। অথচ এক সময় ছিল বিপরীত চিত্র। চিয়ানগু নামের ৫১ বছর বয়সী এক গ্রামবাসী বলেন, আগে এক সময় আমরা ডজন ডজন ডিম আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে এমনিতে দিয়ে দিতাম। কারণ, আমাদের বিক্রির জায়গা ছিল না। কে জানতো অনলাইনে ডিম বিক্রি করা যাবে। তাজ্জব ব্যাপার!
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা পাতিগুল হালিক বলেন, আমাদের গ্রামে কোনো মুরগির খামার নেই। গ্রামের মানুষ যে মুরগি ও ডিম নিজেরা খায়, তা-ই শহরে পাঠায়। এ কারণেই আমাদের পণ্য অনলাইনে এতো জনপ্রিয়।
গত মাসে (নভেম্বর) একটি দোতলা ই-কমার্স সার্ভিস সেন্টার চালু করা হয়। উদ্দেশ্য হলো, উৎপাদিত পণ্য প্যাকেটজাত করে সারা দেশে পাঠানোর আগে সংগ্রহ, মজুদ ও প্রক্রিয়াজাত করা। গ্রামপ্রধান ঝু রেন বলেন, আগামী বছরের শেষ নাগাদ এই গ্রামের কোনো বাসিন্দা গরিব থাকবে না।

Print Friendly, PDF & Email