শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

বাংলা নববর্ষের ইতিকথা

আবদুল হাফিজ খসরু : পৃথিবীতে প্রত্যেক ভাষাভাষীর রয়েছে নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি। যা অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এসব সংস্কৃতি গড়ে ওঠে ভৌগলিক অঞ্চলভিত্তিক। তবে এখানে ধর্মের কিছু প্রভাবও থাকে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের এমনই একটি সংস্কৃতি। বাংলা নববর্ষ একদিকে যেমন বাঙালী সংস্কৃতির, অন্যদিকে মুসলিম ঐতিহ্যের। একটু পেছনের ইতিহাস ঘাটলেই আমরা পেয়ে যাই বাংলা নববর্ষের প্রচলনের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক।
 
ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস আমরা জানি। মুঘল সম্রাটরা এ অঞ্চলে ইসলামী অনেক বিধি বিধান ও ঐতিহ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলন করেছিলেন। তাঁরা এ অঞ্চলে মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন সাড়ে তিনশত বছর। এর মধ্যে মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি উপকার করেছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর। সম্রাটরা হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও প্রচুর সহযোগীতা করতেন। স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালনে সহযোগীতাসহ আর্থিক সহযোগীতাও এসব মুসলিম শাসক করতেন।
 
মুঘলদের তৃতীয় সম্রাটের নাম ছিল আকবর। তিনিই মূলত বর্তমান প্রচলিত বাংলা নববর্ষের উদ্ভাবক। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আকবর ১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এদিনটি ছিল আরবী সন ৯৬৪ হিজরির ১ মুহররম। ঐসময়ে এই উপমহাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে অফিসিয়ালি হিজরি সনই প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি। কিন্তু হিজরি ছিল চন্দ্রবর্ষ অর্থ্যাৎ এখানে বছর গণনা হয় ৩৫৪ দিনে। চন্দ্রবর্ষে ঋতুগুলির হিসাব ঠিক থাকে না। প্রতিবছর এখানে ঋতু অাবর্তন ১০/১৫ দিন করে কমবেশী হয়। অথচ কৃষিনির্ভর ভারতের চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এসব কারণ দেখিয়ে সম্রাট আকবর সিদ্ধান্ত নিলেন সৌরবর্ষ ভিত্তিক আলাদা একটি ফসলী সন প্রবর্তন করার। যদিও এর পিছনে অন্যতম কারণ ছিল সম্রাটের হিন্দুপ্রজাদের খুশি রাখা এবং তাঁর প্রবর্তিত ‘দ্বীন-ই-এলাহী’র ভিত্তি মজবুত করা।
 
অবশেষে সম্রাট আকবর তাঁর সিংহাসনে আরোহনের ২৯তম বর্ষে অর্থ্যাৎ ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ সৌরবর্ষভিত্তিক একটি সন চালুর নির্দেশ দিলেন। এর গণনা শুরু হয় সম্রাটের সিংহাসনে আরোহনের দিনটি থেকে। অর্থ্যাৎ ২৮ বছর পূর্বে ৯৬৪ হিজরির ১ মুহররম থেকে। এই সনের নাম ছিল ‘তারিখ-ই-এলাহী’ বা ‘ফসলি সন’। অন্যদিকে তৎকালীন সময়ে বঙ্গ অঞ্চলে অর্থ্যাৎ বর্তমান উভয় বাংলায় সৌরবর্ষভিত্তিক ‘শকাব্দ’ বা ‘শক’ নামে আরেকটি ফসলী সন প্রচলিত ছিল। যার প্রথম মাস ছিল ’চৈত্র’। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই সন অনুসরণে পূজা-পার্বন পালন করতো।
 
এদিকে হিজরি সনের সমান্তরালে আরেকটি নতুন সনের উদ্ভাবনে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হলো। একদিকে ‘দ্বীন-ই-এলাহী’ নামক নতুন ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠা অন্যদিকে ‘তারিখ-ই-এলাহী’ নামক নতুন সন প্রতিষ্ঠা ! আকবরের রাজসভার জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহ উল্লাহ খান সিরাজী সম্রাটকে এক্ষেত্রে চৌকষ একটি পরামর্শ দিলেন। তা হলো, ‘শকাব্দ’ সনের ১২ মাসের সাথে মিল রেখে ‘তারিখ-ই-এলাহী’ বা ফসলী সনের ১২ মাসের নামকরণ এবং হিজরি সনের সাথে মিল রেখে তার সাল সংখ্যা ঠিক রাখা। এতে করে মুসলিম ও হিন্দুসম্প্রদায়ের উভয়কেই খুশি রাখা যাবে।
 
যে বছর ‘তারিখ-ই-এলাহী’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে বছর ছিল ৯৬৩ হিজরির মহররম মাস। জ্যোতির্বিদ সিরাজী ইসলামী সন হিজরির সাথে মিল রেখে বৈশাখকে প্রথম মাস ধরে সম্রাটকে বঙ্গাব্দ সন চালু করার পরামর্শ দিলেন। সেমতে ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম হচ্ছে ৯৬৩ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ। এভাবেই বর্তমান বঙ্গাব্দ সনের শুরু হয় এবং প্রারম্ভিককাল থেকেই মুসলিম ঐতিহ্য ওতপ্রোতভাবে জুড়ে যায়। আর জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বৎসর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে। হিজরি হচ্ছে চন্দ্রবর্ষ, বঙ্গাব্দ হচ্ছে সৌরবর্ষ। শুরুতে এক থাকলেও বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার ৪৭৬ বছর পর এ দু’টি পঞ্জিকার ব্যবধান এখন এসে দাঁড়িয়েছে ১৪৩৯ হিজরি – ১৪২৫ বঙ্গাব্দ = ১৪ বছর।
 
সুতরাং বঙ্গাব্দ হচ্ছে বাঙালী মুসলিম ঐতিহ্যের সন। তাই বাংলা নববর্ষ উদযাপনও হওয়া চাই বাঙালী মুসলিম ঐতিহ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম ঐতিহ্যের পরিপন্থি কার্যকলাপ দিয়ে বাংলা নববর্ষ ঘটা করে উদযাপন করা হচ্ছে। যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রা, সঙ্গীতানুষ্ঠান, অশ্লীল নৃত্য ও নারী-পুরষের অবাধ মেলামেশা প্রভৃতি। এসব অনুষ্ঠানে আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও দেয়া হচ্ছে।
 
আবহমানকাল থেকে ১লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য আনন্দের দিন। ব্যবসায়ীরা এদিন বিগত বছরের বকেয়া হিসাবের খাতা বন্ধ করার জন্য ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এখানে গ্রাহকরা এসে মিষ্টিমুখ করতেন এবং যার যার বকেয়া পাওনা টাকা ব্যবসায়ীকে পরিশোধ করতেন। জমিদাররা এদিন কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য ‘পুণ্যাহ’ উৎসব করতেন। ১লা বৈশাখের দিন সকালে গ্রাম-বাংলায় মেলা বসতো। এই মেলায় সারা বছরের গৃহস্থালীর অতীব প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতেন গ্রামের মানুষেরা। এসব অনুষ্ঠানের সাথে ইসলামের কোন সংঘাত ছিল না। কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্য বিদ্বেষী সংগঠনগুলো ১৯৬০ সালের পর থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে নতুন কিছু অনুষ্ঠান চালু করে। এসব অনুষ্ঠানে মুসলিম সংস্কৃতির সাথে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে বাঙালী সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রা, সঙ্গীতানুষ্ঠান, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, মেলায় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা প্রভৃতি। মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানে হিন্দুদের পুজা সংস্কৃতি প্রকাশ্যে অনুসরণ করা হয় যা আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
 
আবহমানকাল ধরে বাঙালীরা বাংলা নববর্ষে যে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করতো বর্তমানে আমাদের তাই করা উচিত। সেই উৎসবে ছিল না কোন চাপিয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দুধর্মের রথযাত্রার আদলে উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুসলমানদের উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা একধরণের সাম্প্রদায়িকতা। সরকারি সার্কুলার দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশনা এসব সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আমরা সব সাম্প্রদায়িকতা বর্জন করি।