বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিআরটি : ২০ মিনিটে এয়ারপোর্ট টু গাজীপুর

bangkok_brt_251644766নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলার শহরগুলোর যাতায়াত সহজ করতে পৃথক দুইলেনে বাস চলাচলের একটি আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) আইন, ২০১৬’ আইনের খসড়ায় গাজীপুর থেকে ঢাকায় যাত্রীদের যাতায়াত দ্রুত ও নির্বিঘ্ন করতে পৃথক দুইলেনে বাস চলাচলের কথা বলা হয়েছে।
বিআরটি আইন বাস্তবায়ন হলে গাজীপুর থেকে ২০ মিনিটে বিআরটি বাস চলে আসবে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। ছয় লেনের রাস্তায় দু’টি লেন দিয়ে শুধু বিআরটি বাস চলবে, অন্য কোনো যানবাহন চলবে না। এতে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হচ্ছে ৭০ কোটি টাকা বা ৯০ লাখ ডলার, যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল। তাইওয়ানে ব্যয় হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ৫ লাখ ডলার। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তৈরি করা এক প্রতিবেদনে ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জনসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন, দ্রুত ও আরামদায়ক করাই উদ্দেশ্য।
আইনে জেল-জরিমানা এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ছাড়াও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান রাখা হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া বিআরটি নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। অনুমোদন ব্যতিরেকে লাইসেন্স হস্তান্তর করলে ১০ বছর জেল বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়।
অনুমোদনহীন বিআরটি বাস টিকিট বিক্রয় বা পাস বিক্রি বা জাল করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়। আর কর্মচারী কর্তৃক করলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হবে। বিশেষ এই সার্ভিসের ভাড়া নির্ধারণ করবে বিশেষ কমিটি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব বলেন, নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে ভাড়া নির্ধারণের জন্য সাত সদস্যের কমিটি গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কমিটি ভাড়া যাচাই-বাছাই করবে।
এছাড়া খসড়া আইনে যাত্রী পরিবহন সংক্রান্ত তথ্য এবং ভাড়া ওয়েবসাইট ও বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করার নির্দেশনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রথম বিআরটি চালু হয় ব্রাজিলের কুরিটিবা শহরে ১৯৭৪ সালে। ৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি চালু করতে সে সময় ব্যয় হয় ৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ছিল ১৫ লাখ ডলার। ২০১১ সালে কুরিটিবায় নতুন আরেকটি বিআরটি চালু করা হয়। এতে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ২৫ লাখ ডলার। ২০০০ সালে কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় বিআরটি চালু করা হয়। ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ৫৩ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে ২০০৪ সালে চালু করা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিআরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ১৭ লাখ ডলার। ব্রাজিলের সাওপাওলোতে ২০০৫ সালে ১১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। এতে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ লাখ ডলার। ২০০৮ সালে ইকুয়েডরের কিয়োটো শহরে ৩৭ কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণে ব্যয় হয় ২ কোটি ২২ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ৬ লাখ ডলার। ২০১০ সালে তাইওয়ানের তাইপে শহরে বিআরটি চালু করা হয়। ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ব্যবস্থা নির্মাণে ব্যয় হয় ২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ছিল ৫ লাখ ডলার।

এদিকে নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০১২ সালে ভারতের আহমেদাবাদে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি চালু করেন। এতে ব্যয় হয় ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ১৯ লাখ ৩১ হাজার ডলার। এটি ভারতে সবচেয়ে সফল বিআরটি ব্যবস্থা। আর ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ব্রাজিলের পের্তো অ্যালেগ্রে শহরে ৩৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার বিআরটি চালু হয় গত ১৪ মার্চ। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ১০ লাখ ডলার।

এ প্রসঙ্গে বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় বিআরটি সবচেয়ে কম ব্যয় সম্পন্ন একটি পদ্ধতি। খুব বেশি জটিলতা না থাকায় এটি খুব দ্রুত চালু করা যায়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিআরটি নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলার। তবে বাংলাদেশে এ ব্যয় অনেক বেশি হচ্ছে। মূলত অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থায় বিআরটি চালু করার কারণেই ব্যয় বেশি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো শহরে বিআরটি ব্যবস্থা চালু করতে খুব বেশি কাজ করতে হয় না। বিদ্যমান সড়কের দুই পাশে ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) দিয়ে বাসের জন্য পৃথক লেন করলেই হয়। আর চলাচলের রুটের মধ্যে কোনো জংশন (মোড়) থাকলে সেখানে বিআরটির বাসকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগনাল ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। বাস মোড়ের কাছাকাছি আসার পর সিগনাল বাতি জ্বলে। এতে মোড়ে অন্যান্য যানবাহন বন্ধ করে বিআরটির বাসকে আগে যেতে দেওয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email