সালতামামি ২০১৯

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ৩২ জন গ্রেফতারে আলোড়ন

আতাউর রহমান |♦|

রাজধানীসহ সারা দেশে এ বছরের শেষের দিকে হঠাৎ করে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এ অভিযান শুরু করে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড আকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। পরে এতে যোগ দেয় থানাপুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য ইউনিট। ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ অভিযান প্রথম দেড় মাস দেশ-বিদেশে ছিল ব্যাপক আলোচিত। এ সময়ে ২২টি স্থানে ৩০টি অপারেশন চালায় র‌্যাব। এসব অভিযানে ৯ ভিআইপিসহ ৩২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ২২টি অস্ত্র, টর্চারসামগ্রী, সাড়ে ৮ কোটি টাকা ও চার কোটি টাকা মূল্যের ৮ কেজি স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়। পৌনে ২০০ কোটি টাকার বেশি এফডিআর-চেক উদ্ধার করা হয়। দেড় মাসের ক্রমাগত অভিযানে আতঙ্ক ঘিরে ধরে দুর্নীতিবাজদের। অনেকেই চলে যান আত্মগোপনে। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও অভিযান বন্ধ হয়নি। সবশেষ ৩১ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুকে গ্রেফতারের পর আর কোনো অভিযান দৃশ্যমান হয়নি।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আত্মগোপনে যাওয়াদের মধ্যে এখনও যারা পলাতক আছেন তাদের মধ্যে রয়েছে- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের সাবেক নেতা কাজী আনিসুর রহমান, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু, যুগ্ম সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া প্রমুখ।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকে বিশেষ অভিযান উল্লেখ করে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা জানায়, তাদের অভিযান এখনও বন্ধ হয়নি। সমাজের অরাজকতা তৈরিকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কৌশলগত কারণে অভিযানে সাময়িক ভাটা পড়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত (৩১ অক্টোবর পর্যন্ত) যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া (ইয়াং ম্যানস ক্লাবের পরিচালক), জিকে শামীম (সাত দেহরক্ষীসহ), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ (কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, সম্রাটের সহযোগী এমরানুল হক আরমান, জাকির হোসেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, তারেকুজ্জামান রাজি, ময়নুল হক মঞ্জু, মঞ্জুর গাড়িচালক সাজ্জাদ হোসেন, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সাইফুল ইসলাম, তুহিন মুন্সি, নবীর হোসেন সিকদার, অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনাকারী আক্তারুজ্জামান ও রোকন মিয়া।

র‌্যাবের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা জব্দ হয়েছে। ১৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার এফডিআর, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩২টি চেক বই ও ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক উদ্ধার করা হয়েছে। ৭ দশমিক ২০ ভরি (আট কেজি) স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২২টি অস্ত্র জব্দ করা হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে অবৈধ অস্ত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার। এছাড়া বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, মদ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। খালেদ ও সম্রাটের অফিস থেকে জব্দ করা হয়েছে টর্চারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও ইলেকট্রিক শকের মেশিন। র‌্যাব যে ১১টি ক্যাসিনো-ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে, এর মধ্যে ঢাকার ৮টি ও চট্টগ্রামের তিনটি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে করা মামলাগুলোর মধ্যে ১২টির তদন্ত করছে র‌্যাব। এসব মামলা মূলত অস্ত্র ও মাদক আইনে করা। চারটি মামলায় এরই মধ্যে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

এদিকে র‌্যাব ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থানা পুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের তৎপরতা শুরু করে। থানা পুলিশ রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অভিযান চালালেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সংশ্লিষ্টদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করে দুদক। দুই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে বলে জানিয়েছেন দুদক মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-অর্গানাইজড ক্রাইম) মোস্তফা কামাল বলেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে করা মানি লন্ডারিং মামলাগুলো আমরা তদন্ত করছি। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে আটটি মামলা আছে। চলতি বছরের মধ্যেই এসব মমালার তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ীই তদন্ত চলছে।

Print Friendly, PDF & Email