র‌্যাবের নজরদারিতেই প্রতারক সম্রাট সাহেদ, যে কোন সময় গ্রফতার!

এবিএন হুদা ◾

প্রতারক সম্রাট ও করোনা পরীক্ষা নিয়ে মহাজালিয়াতির হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ কি র‌্যাবের নজরদারিতেই আছেন? যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে? হ্যাঁ, তেমন আভাসই দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র।

জালিয়াতিসহ নানা দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার পাঁচ দিনেও গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। র‌্যাব-পুলিশসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও বিষয়টি আঁচ করতে পারছেন। জল, স্থল এবং দেশের সবকটি বিমানবন্দরে সাহেদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা পাঠানোর পাশাপাশি তাঁর গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছেে। গ্রেফতারে বিলম্ব হওয়ায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠার বিষয়টিও সংশ্লিষ্টদের মাথায় আছে ।

র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, প্রতারক সাহেদের নামে উত্তরা থানায় মামলা হওয়ার পর সে র‌্যাবের নজরদারিতেই আছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার তার কোনো উপায় নেই। তাকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে।

এদিকে তার বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারিতে হওয়া আরও তিনটি মামলার সন্ধান পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র বলছে, উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের দিনই সটকে পড়েন সাহেদ। দেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে প্রথমে

রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান নিয়েও ভাবনায় পড়ে যান আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। এ সুযোগে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালানোর আগেই সংবাদ সম্মেলন করেন সাহেদ। তবে সর্বশেষ রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালানোর পর রাতেই আত্মগোপনে চলে যান তিনি। এর মধ্যে তিনি বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।

অপকর্মের সুযোগ দিয়ে অতীতে তার কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিলেও সেই রাতে সবাই মুখ ফিরিয়ে নেন। সব শেষ সাহেদ চলে যান নরসিংদীতে তার এক ঘনিষ্ঠজনের কাছে। তবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সেখানে যাওয়ার আগে স্থান ত্যাগ করে পুনরায় রাজধানীর গুলশানে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে আসেন সাহেদ। ওই আত্মীয় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাকে বেশি সময় অবস্থান করতে দেননি। ধূর্ত সাহেদ তখন চলে যান কুমিল্লায় এক পরিচিতজনের কাছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে সেখান থেকেও অন্যত্র চলে যান তিনি। যেসব জায়গায় সাহেদ অবস্থান করেছিলেন তাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

সূত্র আরও বলেছে, সাহেদের ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম তারেক শিবলীর কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শনিবার উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে গিয়ে দ্বিতীয় তলার কিচেন রুম থেকে কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের বিভিন্ন ভাঙা অংশ ও অনেকগুলো পাসপোর্ট উদ্ধার করে র‌্যাব। অন্য একটি কক্ষ থেকে সাহেদ ও তার প্রয়াত বাবা সিরাজুল করিমের পাসপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ করা হয়। অভিযানের আগে রিজেন্ট হাসপাতালের বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের তৎপরতার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এসব হার্ডডিস্ক নষ্ট করার চেষ্টা করে সাহেদ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ‘আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে এখানে এসেছি। পরে এ বিষয়ে জানানো হবে। ’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, করোনা সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রিজেন্ট হাসপাতালে একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে। তারা ভুয়া করোনা প্রতিবেদন দিয়ে গুরুতর অপরাধ করেছে। তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় আসামি করা হয়েছে ১৭ জনকে। ইতিমধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত হচ্ছে। সাহেদের পৃষ্ঠপোষক ও ইন্ধনদাতাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে একটি বীমা কোম্পানির পলিসিম্যান হিসাবে তার ঢাকায় কর্মজীবন শুরু। পরে তিনিসহ আরো ৫ বন্ধু মিলে ২০১১ সালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায়  বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি নামে দু’টি এমএলএম কোম্পানি খুলে বসেন। গ্রাহকের ৫ কোটি টাকা মেরে তিনি জেলে যান। ৬ মাস জেল খেটে সাহেদ জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে আসেন।

তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সাহেদসহ যে ৫ জন বন্ধু মিলে তারা ওই প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন সেই পাঁচ বন্ধুর ২ জন বিদেশে চলে গেছেন। একজন মারা গেছেন। আর দুইজন গ্রামে ছোটখাট ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আর এদিকে অভিনব প্রতারণা করে সাহেদ তার জীবনের দিনবদল করেন। 

সূত্র জানায়, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি অন্যরকম ফন্দি আটেন। রাজনৈতিক দল এবং সমাজে যাদের প্রভাব রয়েছে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এক নেতার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ওই নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন। তার মাধ্যমেই খুলনা অঞ্চলের ক্ষমতাসীন দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তিনি যেখানেই যেতেন তার পিছু পিছু যেতেন তিনি। সবাই তাকে তার ডান হাত হিসাবে জানতেন এবং মানতেন। তাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বাগিয়ে নিয়েছেন টেন্ডার। তার নাম ভাঙ্গিয়ে গড়েছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান। সাহেদ তার প্রতিষ্ঠানের লাভের একটি অংশ তাকে সরবরাহ করতেন।  

সূত্র জানায়, এতে তিনি দিনদিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ওই নেতা বিভিন্ন মিডিয়ায় টকশোতে গেলে সাহেদও সেখানে যেতেন। তার হাত ধরেই এক বাকপটু সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাহেদের। এরপর থেকেই তিনি একাধিক টেলিভিশনের টকশোতে যেতেন। অনেক টিভিতে ওই সাংবাদিক টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে বলতেন যাতে সাহেদকে ডাকা হয়। এতে অল্প সময়ে সাহেদ টেলিভিশনের পরিচিত মুখ বনে যান। লোকজন তাকে অনেক কিছুই ভাবতে থাকে। ওই সাংবাদিককে তিনি বিদেশে যাওয়ার প্লেনের টিকিট করে দিতেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও একাধিকবার থাইল্যান্ডের হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন সাহেদের টাকায়।

সূত্র জানায়, সাহেদ যে রিজেন্ট হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন তার পেছনে মূল হাত রয়েছে মরহুম এক এমপির ছেলের। করোনা পরীক্ষা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের যে চুক্তি হয় সেখানেও ওই এমপির ছেলের হাত রয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য বিভাগে টেন্ডারে ছিল সাহেদের হাত। যদি কোনো টেন্ডার হতো তাহলে শাহেদ টেন্ডার ফরম জমা করলে বাকিরা বুঝে নিতেন যে তারা এই কাজটি পাবেন না।

সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের আগষ্ট মাস থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক নারী উপস্থাপিকার সঙ্গে তার দহরম মহরম সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারা সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এক সঙ্গে যেতেন। সাহেদের স্ত্রীও বিষয়টি জানতেন। তিনি এই বিষয়টি জানার পর একাধিকবার বাবার বাড়ি চলে গেছেন। আবার ফিরে এসেছেন। সূত্র জানায়, সাহেদের বড় সহযোগী ছিলেন ওই নারী। প্রয়োজনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তবে  তিনি দুইদিন ধরে আত্মগোপনে গেছেন।

সাহেদের বেড়ে ওঠা তার দাদার বাড়িতে। সাহেদের মা স্থানীয় পর্যায়ে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। প্রায় ১১ বছর আগে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান তিনি। সাহেদের চাচা বলেন, ব্যক্তি সাহেদ সম্পর্কে আমরা এতো কিছু জানতাম না। দয়া করে আমাদের এসবের সঙ্গে যুক্ত করবেন না।

ডিএন/সিএন/বিএইচ/০৬ঃ৪০এএম/১২০৭২০২০-১

Print Friendly, PDF & Email