৭ দিনেও গ্রেফতার না হওয়ায় প্রশ্ন

সাহেদ কি রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়েও শক্তিধর

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী ◾

করোনা টেস্ট জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম ও প্রতারণার দায়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক পলাতক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে সাত দিনেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাহেদ আসলে কোথায় আছে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে এক ধরনের ধোঁয়াশা। সাহেদ গোপনে দেশ ছেড়েছেন এমন কথাও চাউর হচ্ছে।

এদিকে কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে সাহেদ ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন এমন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশিও চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যদিও শেষ পর্যন্ত সাহেদকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সাহেদ গ্রেফতার না হওয়ায় চায়ের স্টল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনেও সরকারের সমালোচনা হচ্ছে।

বিরোধী দল বিএনপি বলছে, সাহেদ সরকারি দলের লোক। সরকারের মদদেই এতদিন ধরে এসব অপকর্ম করে আসছে। এখনো সাহেদকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না-এমন প্রশ্নও তুলেছে দলটি।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সাহেদ দেশেই আছে। তিনি যদি আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। তাকে গ্রেফতারের জন্য র‌্যাব-পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
এছাড়া সাহেদ গ্রেফতার না হওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বলছেন-সাহেদকে নিয়ে সরকার লুকোচুরি খেলছে। সাহেদের ক্ষমতাতো আর সরকারের ক্ষমতার চেয়ে বড় নয়। সরকার চাইলেই তাকে গ্রেফতার করতে পারে।

এদিকে এখনো সাহেদ গ্রেফতার না হওয়ায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরা। সরকারের উপর মহলের সঙ্গে সাহেদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মঙ্গলবার দেশনিউজকে বলেন, সাহেদের এই ঘটনা দেশে প্রতারণার ধারাবাহিকতা। দেশে প্রতারণা হচ্ছে না কোথায়? বিভিন্ন সেক্টরে লুটপাট-দুর্নীতি ও প্রতারণা হচ্ছে। ৩০ ডিসেম্বর যে ভোট হয়েছিল সেটাওতো প্রতারণা ছিল। আর সাহেদ যা করেছে এটা মহা প্রতারণা। আমাদের দেশটা আসলে এখন প্রতারকের দেশ হয়ে গেছে।

এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না-এই বিষয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, এটাতো আমারও প্রশ্ন। সরকার এখনো তাকে গ্রেফতার করছে না কেন? তিনি বলেন, সরকার যাদেরকে পছন্দ করে না শুধু তাদেরকেই দ্রুত গ্রেফতার করে। ভিন্নমতের হলে গ্রেফতার করতে এত সময় লাগে না।

বাংলাদেশের করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ নিয়ে ইতালির গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে এই বিশ্লেষক বলেন, এতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম মারাত্মভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এটার প্রভাব শ্রমবাজারে পড়তে পারে। আর এদেশে প্রতারকদের বিচার হয় না। যার কারণে এগুলো হচ্ছে। অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি আর প্রতারণা যারা করছে সরকার যদি এদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতো তাহলে আজ এ অবস্থা হতো না।

আর সরকারের উপর মহলের সঙ্গে সাহেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন আরেক রাজনীতিক বিশ্লেষক, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও সাবেক জজ ইকতেদার আহমেদ।
মঙ্গলবার দেশনিউজকে ইকতেদার আহমেদ বলেন, ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ নেতার সঙ্গে সাহেদের হাস্যজ্জ্বল ছবি আছে। ছবিগুলোতে তাদেরকেও উৎফুল্ল দেখা যাচ্ছে। বঙ্গভবনের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সাহেদ দাওয়াত পায় কিভাবে? সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে যায় কিভাবে? ঢাকার বাইরে গিয়ে সাহেদ পুলিশি নিরাপত্তায় চলাফেরা করে কিভাবে? ছবিগুলো বলছে- সরকারের উপর মহলের লোকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে চিঠি দেয়া হয়েছিল সাহেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কিন্তু তখন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেটাওতো একটা প্রশ্ন। সেই সময় ব্যবস্থা নিলে হয়তো সাহেদ এতদূর আসার সুযোগ পেতো না।

ইকতেদার আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমের কিছু সাংবাদিক সাহেদকে টকশোতে এনে দেশবাসীর কাছে তাকে রাজনীতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ সুযোগটাকেও সাহেদ কাজে লাগিয়েছে। ওইসব সাংবাদিকরাও দায় এড়াতে পারেন না।
এত বড় প্রতারণার পরও সাহেদ এখনো গ্রেফতার হচ্ছে না-এ বিষয়ে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীতো বলছেন-সাহেদ দেশেই আছে। র‌্যাবও বলছে-তারা সাহেদকে গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছেন। এখন ডিজিটাল যুগ। সবকিছুই হাতের মুঠোই। সাহেদকে দ্রæত গ্রেফতার না করলে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হবে।

আর র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেমও গণমাধ্যমকে বলেছেন, সাহেদকে গ্রেপ্তারে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রæটি নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করছি শিগগির ভালো খবর দিতে পারব।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর উত্তরার কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালে গত ৬ জুলাই অভিযান চালান র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান পরিচালনাকালে উঠে আসে হাসপাতালটির অনিয়মের ভয়াবহ সব তথ্য। পরীক্ষা না করেই দেওয়া হতো করোনা পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ রিপোর্ট। পরে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুরের শাখা দুটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করে র‌্যাব। এ ঘটনায় নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাহেদ পলাতক রয়েছে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে।


ডিএন/পিএন/জেএএ/০৪ঃ০০পিএম/১৪০৭২০২০

Print Friendly, PDF & Email