বিশিষ্ট ব্যাংকারের বিশ্লেষণ

সরকারি আদেশ নির্দেশে ব্যাংকিং সেক্টর প্রচন্ড চাপে

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক |

গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, “এপ্রিল মাসে ব্যাংকের মুনাফায় করোনার কামড়”। অর্থাৎ মার্চের চেয়ে এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ধস নেমেছে করোনার কারণে। আসলে কি তাই? ব্যাংকাররা কী ভবছেন? এ নিয়ে দেশনিউজের সঙ্গে কথা বলছেন, বিশিষ্ট ব্যাংকার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত করলেন তিনি। তাঁর মতে, করোনা নয়, সরকারের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া কিছু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তই এ খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।

আমিনুল ইসলাম বলেন , ব্যাংকের মুনাফা ধসের জন্য করোনার কামড়ের সাথে যুক্ত হয়েছে নীতিনির্ধারকদের কামড়। ভয়াবহ করোনার মাঝেও ব্যাংকাররা যে পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিয়ে তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ও দেশের অর্থনীতির চাকা চলমান রাখার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তা বিরল। কিন্ত চাপিয়ে দেয়া কিছু নীতিনির্ধারণী অর্ডার ব্যাংকারদের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে যা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অশনিসংকেত।

তাঁর মতে, নীতিনির্ধারণী সার্কুলারগুলি সংবাদ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় নানাভাবে মিসইন্টারপ্রিট (অপব্যাখ্যা) হয়ে যেভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাতে ব্যাংকাররা তাদের গ্রাহকদের নিকট থেকে মানসিক চাপ তথা মানসিক অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছেন।

“আরো চাই” “আরো চাই” শ্লোগানে উজ্জীবিত মুষ্ঠিমেয় ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে যেয়ে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং এতে করে ভবিষ্যতে স্বেচ্ছাঋণখেলাপীদের সংখ্যা বাড়তে পারে।

মি. ইসলাম বলেন, করোনায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন প্রনোদোনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যা প্রশংসনীয় বটে। তবে এ প্রণোদনার সিংহভাগই ব্যাংক নির্ভর।

তিনি বলেন, সরকারকে এক্ষেত্রে একটি জিনিস দেখা উচিৎ এদেশের ব্যবসায়ীদের প্রকৃত আয়ের বিপরীতে আয়কর দেয়ার প্রবণতা কেমন। SME খাতের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী আয়কর রিটার্ন জমা দেন বাধ্য হয়ে কারণ এটা ছাড়া ব্যাংক ঋণ প্রদান করেনা। কিন্তু সরকারী প্রণোদনার কথা শুনে উনারাই আগে দৌড়াচ্ছেন। উনারা সরকারের কাছ থেকে নিতে ভালবাসেন কিন্তু সরকারকে দিতে ভালবাসেননা।

আমিনুল ইসলাম তাঁর ব্যাংকিং লাইফে মানুষের শঠতা ও দ্বিচারিতার উদাহরণও তুলে ধরেন। তিনি এক এক করে উদাহরণ দিয়ে বলেন,

১) লোন নেয়ার সময় এমনভাবে নিজেকে উত্থাপন করবে যাতে মনে হবে উনার মত সলভেন্ট ব্যবসায়ী ঐ সেক্টরে খুব কমই আছে। আর যে জমি ব্যাংকে মর্টগেজ রাখবে সেটাকে মনে হবে এযেন জমি নয় একটা আস্ত সোনার খনি।

২) লোন আদায়ের সময় মনে হবে তিনি ঋণ পরিশোধ করছেন কতইনা কষ্টে। মনে হয় নিজের পকেটের পয়সা দয়া করে ব্যাংককে দিচ্ছেন।

৩) অমুক ব্যাংক অনেক কম রেইটে লোন দেয় আর আপনারা আমার নিকট থেকে অনেক বেশি রেইট রাখছেন।

৪) ঐ একই ব্যক্তি ডিপোজিট করার সময় রেইট নিয়ে বলবে উল্টো কথা। ব্যাপারটা এমন, লোনের রেইটে যদি আমানত নেয়া যেত আর আমানতের রেইটে যদি লোন দেয়া যেত তবে হয়তো উনারা খুশি থাকতেন।

৫) ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার সময় ছেড়াফাটা নোট, ছোট নোট নেয়ার জন্য রীতিমতো চাপাচাপি করবেন কিন্তু উত্তোলনের সময় চাই বড় ডেনোমিনেশনের চকচকে নোট।

৬) RTGS এর সার্ভিস চার্জ (মাত্র ১০০ টাকা) থেকে বাঁচতে এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে অনলাইনে জমা দেয়া (অনলাইন চার্জ যেহেতু ওয়েইভ করা)।

৭) জমাকৃত টাকার মধ্যে জালনোট পাওয়া গেলে সেটার ফয়সালা করতে যেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদেরই নাস্তানাবুদ হতে হয়।

এতসব চাপ হাসিমুখে বরণ করে নিয়েই ব্যাংকাররা দ্রুত সার্ভিস নিশ্চিত করেন।

এই ব্যাংকার বলেন, উচ্চমূল্যের আমানত (Cost of Deposit+Cost of Operations) যখন বিনামূল্যে বিক্রয় করতে বলা হয় তাও আবার ঋণ ঝুঁকিকে মাথায় নিয়ে তখন যেকোনো ব্যাংকারের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হয়।

এগুলো এপ্রিল মাসে ব্যাংকের মুনাফায় ধস নামার প্রকৃত কারণ।

আরেকটু খোলাসা করে তিনি বলেন, এখনো বিভিন্ন ব্যাংকে ডিপিএস বা স্পেশাল স্কীম চলছে ১০/১১/১২% হারে। মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত এই রেইটেই চলবে। FDR ৬% রেইটে পাওয়া খুব কঠিন। এর সাথে পরিচলন ব্যয় যোগ করলে Cost of Fund দাড়ায় ৯% এর আশেপাশে।
কিন্তু এপ্রিল থেকে সকল ঋণের ইন্টারেষ্ট রেইট বেধেঁ দেয়া হয়েছে ৯%। তাহলে বলুন এপ্রিলে মুনাফার ধসের জন্য শুধুই কি করোনা দায়ী?

তিনি বলেন, আরো জটিল হিসাবে আছে। এপ্রিল ও মে মাসের সকল ঋণের ইন্টারেস্ট আয় খাত থেকে সরিয়ে ব্লক হিসাবে রাখতে বলা হয়েছে। তাহলে আবার একটু পেছনে যাই। এপ্রিলে ব্যাংকগুলি যে সামান্য প্রফিট করেছে সেখান থেকে ইন্টারেস্ট ইনকাম ব্লক একাউন্টে স্থানান্তর করলে লস কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাহলে ব্যাংকগুলি লসে গেলে আমানতকারীদের ইন্টারেষ্ট, ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় ও কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন/বোনাস কে বহন করবে?

এমতাবস্থায় ব্যাংকগুলোকে অবশ্যম্ভাবী তার মূলধনের দিকে হাত বাড়াতে হবে বলে জানিয়ে মি. ইসলাম বলেন, মূলধনে হাত দেয়া এবং নিজের শরীর নিজে কামড়িয়ে খাওয়া একই কথা।

একজন ব্যাংকার হিসেবে নীতিনির্ধারকদের প্রতি সনির্বন্ধ নিবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, দয়া করে কর্পোরেট সুশাসনের উজ্জ্বল আলোক প্রদানকারী এই ব্যাংকগুলোকে বেচেঁ থাকার সুযোগ দিন। ব্যাংক বাঁচলে দেশের অর্থনীতি বাঁচবে-দেশ বাঁচবে এবং ব্যাংকের অগুনিত স্টেইকহোল্ডাররা বাঁচবে।

Print Friendly, PDF & Email