এসপি ওসিসহ ৪ পুলিশ কর্মকর্তা গাফিলতি করেছেন : আদালত

ফেনী প্রতিনিধিঃ

ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান ওরফে রাফি হত্যার ঘটনায় গাফিলতি অভিযোগে সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তিরস্কার করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার নুসরাত হত্যা মামলার রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ এ কথা বলেন।

আদালত বলেন, এ ঘটনায় তৎকালীন ওসি গাফিলতি করেছেন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড আর না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেন আদালত।

প্রসঙ্গত গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় তাঁর মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। তবে তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নুসরাতকে হয়রানি করেন। থানায় নুসরাতের কথাবার্তা তিনি ভিডিও করেন। পরে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তৎকালীন ওসির বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ উঠলে প্রথমে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে আছেন।

তবে আদালত আজ পর্যবেক্ষণে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি

এর আগে বিচারক নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। রায় পড়ার শুরুতেই এই হত্যা মামলায় গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করেন আদালত। আদালত বলেন, গণমাধ্যমের কারণেই এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশবাসী জানতে পারে।

চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ ঃ

রায়ে চারজন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় দেন। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায়ে সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করা হয়।

রায়ে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় ১৬ আসামির অংশগ্রহণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। এছাড়া প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হলো।

মামলার ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।

মামলায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে প্রত্যাহার করা হয়। থানায় হেনস্তা হওয়ার নুসরাতের ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানা পুলিশ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই উপ-পরিদর্শককে (এসআই) বহিষ্কার করা হয় ৮ মে। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়। এগুলো হলো- ১. মামলার কালক্ষেপণ, ২. এজহার নিয়ে কূটচাল, ৩. গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ, ৪. নুসরাতকে থানায় জবানবন্দির নামে ওসির হেনস্তা, ৫. আইনি বহির্ভূত জিজ্ঞাসাবাদ, ৬. প্রথমে অজ্ঞাত মামলা, পরে ৮ জনের নামোল্লেখ।



নুসরাতকে অধ্যক্ষের শ্লীলতাহানি করার ঘটনায় মায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু মামলা তুলে না নেওয়ায় ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় বোরকা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান ওরফে নোমান বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

পরে এই মামলা তদন্ত করে পিবিআই। গত ২৮ মে পিবিআই তদন্ত শেষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে। মাত্র ৬১ কার্যদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আর মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পিবিআইয়ের লাগে ৩৩ কার্যদিবস।

Print Friendly, PDF & Email