খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানি ঘিরে হট্টগোল যেভাবে শুরু

আদালত প্রতিবেদক |

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের আদেশ না নিয়ে আদালত ত্যাগ করতে যাওয়া সিনিয়র আইনজীবীদের অবরুদ্ধ করে রেখেছেন বিএনপি সমর্থক জুনিয়র আইনজীবীরা।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া জামিন চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন। এই আবেদনের শুনানিতে গত ২৮ নভেম্বর আদালত খালেদা জিয়ার সবশেষ স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কে জানাতে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে বোর্ডের মেডিকেল প্রতিবেদন ৫ ডিসেম্বরের (আজ) মধ্যে আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে গঠিত আরেকটি মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনও দাখিল করতে বলেছিলেন আদালত।

আজ ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য উঠলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। কিছু পরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন দিতে হবে বলে তাঁকে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য সময় দরকার।

তখন খালেদা জিয়ার পক্ষের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আগের একটি রিপোর্ট আছে। শুনানি হতে পারে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ওই রিপোর্ট আমাদের দেওয়া হয়নি।

পরে রিপোর্টটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে দেখানো হয়। তখন তিনি বলেন, এটা গোপনীয়। এটা কীভাবে বাইরে আসে।

জয়নুল আবেদীন বলেন, বোর্ড হয়েছে। খালেদা জিয়ার অবস্থা খারাপ। চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাইরে নেওয়া দরকার।

অ্যাটর্নি জেনারেল ওই বোর্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, অথরিটি হচ্ছে বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য। তিনি বলেছেন, টেস্ট শেষে রিপোর্ট দিতে পারবেন। সময় লাগবে।

তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, বোর্ড তো আমরা করিনি।

এ অবস্থায় জয়নুল আবেদীন গত ২৮ নভেম্বরের আপিল বিভাগের আদেশ পড়ে শোনান। ওই আদেশে গত ৭ অক্টোবরে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন দাখিলের কথাও রয়েছে।

জয়নুল আবেদীন বলেন, মানবিক আবেদন, জীবন রক্ষার জন্য জামিন দেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ইমোশনাল কথা বলবেন না।

এই কথায় আপত্তি জানান জয়নুল আবেদীন।

খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, এত দুঃসাহস পেলেন কোথায়? সর্বোচ্চ আদালত আদেশ দিয়েছেন।

খোকনের এই বক্তব্যে আপত্তি জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

প্রধান বিচারপতি বলেন, রিপোর্ট আসুক। বিষয়টি আগামী বৃহস্পতিবার থাকবে।

জয়নুল আবেদীন বলেন, দীর্ঘ সময়। ইনজাস্টিস হবে। সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আস্থা আছে, সে জন্য বলছি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, এ জন্য আমরা রিপোর্ট কল করেছি।

জয়নুল আবেদীন বলেন, রিপোর্ট আসা ২৪ ঘণ্টার বিষয়। খালেদা জিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ।

এ অবস্থায় আদালত বলেন, বিষয়টি বৃহস্পতিবার থাকবে। একসঙ্গে দুটি রিপোর্ট দেখা হবে।

জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়া অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় আছেন। আদালত চাইলে তাঁকে হাজির করে দেখতে পারেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, সব হবে। আগে রিপোর্ট আসুক।

জয়নুল আবেদীন বলেন, সোমবার করুন।

তখন খোকন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের অ্যাডভাইসে রিপোর্ট আসেনি।

এ সময় উপস্থিত আইনজীবীদের মধ্যে হইচই শুরু হয়।

একপর্যায়ে আদালত বলেন, চিৎকার করলে শুনব কী করে।

বিএনপির আইনজীবীরা চিৎকার করে বলতে থাকেন, জামিন চাই, জামিন চাই।

এ অবস্থায় আদালত আদেশ দেন।

আদালতের আদেশ দেওয়ার পরও হইচই চলে। পরে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারপতিরা।

বিচারপতিরা চলে যাওয়ার পরও বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা আদালতকক্ষে বসে থাকেন।

বিরতির পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিচারপতিরা এজলাসে আসেন। অন্য মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। তখনো বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা আদালতকক্ষে বসেছিলেন। তাঁরা হইচই করেন। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘বেইল ফর খালেদা জিয়া’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ে খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়। এই সাজা বাতিল চেয়ে গত বছরের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। শুনানি নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল হাইকোর্ট ওই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতে দেওয়া জরিমানার আদেশ স্থগিত করে বিচারিক আদালতে থাকা মামলাটির নথি তলব করেন হাইকোর্ট। গত ২০ জুন মামলার নথি হাইকোর্টে আসার পর খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন আদালতে তুলে ধরেন তাঁর আইনজীবীরা। গত ৩১ জুলাই জামিন আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট। পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আপিল বিভাগে যান।

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে তার আইনজীবীদের মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এজে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, বদরুদ্দোজা বাদলসহ প্রমুখ আইনজীবী অংশগ্রহণ করেন। দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

জুনিয়র আইনজীবীদের অবরুদ্ধের মুখে পড়ে দলের সিনিয়র আইনজীবীরা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এজে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সবাইকে শান্ত হয়ে আদালত ত্যাগের নির্দেশ দেন। অনড় জুনিয়র আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার জামিনের আদেশ ব্যতীত আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষ ত্যাগ না করতে সিনিয়রদের হুঁশিয়ারি দেন। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের  কয়েকদফা বাকবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা যায়।

এর আগে চ্যারিটেবল মামলায় গত ৩১ জুলাই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করেছিলেন। এরপর গত ১৪ নভেম্বর হাইকোর্টের খারিজাদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেন তার আইনজীবীরা। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ১৪০১ পৃষ্ঠার ওই আপিল আবেদন দাখিল করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত ৩০ এপ্রিল জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে অর্থদণ্ড স্থগিত এবং সম্পত্তি জব্দের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়ে দুই মাসের মধ্যে ওই মামলার নথি তলব করেছিলেন আদালত।

এরপর ২০ জুন বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। গত বছরের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের সাত নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা করেন। এ মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email