আজ আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস

কাল আইসিজের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন সু চি

নিউজ ডেস্ক |

আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস অত্যন্ত তাৎপর্যপূূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। এবার দিবসটি ভিন্নরূপে এসেছে। মিয়ানমারে গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক। এবার বিশ্ব যখন গণহত্যা দিবস পালন করতে যাচ্ছে, মিয়ানমার তখন এই বর্বরতম অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের  (আইসিজে) কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা গণহত্যা মামলায় আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘের এ আদালত কী সিদ্ধান্ত নেন, তা জানতে এখন সবার চোখ নেদারল্যান্ডসের হেগে।

বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে মিয়ানমারের এই বর্বরতাকে আইসিজেতে তোলা হয়েছে গত মাসে। নিরস্ত্র জনগণের ওপর গণহত্যা চালানোর অপরাধে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাইছেন বিশ্বের শান্তিকামী ও মানবতাবাদী সব মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এই গণহত্যার বিচারের জোরালো দাবির মধ্যেই আজ সোমবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিভিন্ন দেশে গণহত্যার ঘটনা স্মরণ এবং এর বিরুদ্ধে সর্বজনীন সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ৯ ডিসেম্বর গণহত্যাবিরোধী জাতিসংঘ কনভেনশন গৃহীত হয়। ওই বছর থেকেই এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

মিয়ানমারে গণহত্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বছরের পর বছর বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বোঝা বইছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে নেওয়া পদক্ষেপ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে মিয়ানমারের কূটচালে।

জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে রাখাইনে গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পর বিশ্বজুড়েই এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিও জোরালো হচ্ছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারীরাও বিচার চাচ্ছেন গণহত্যার। অবশেষে মিয়ানমারে সেই গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। শুনানি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দলও উপস্থিত থাকবে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিচার চেয়ে তিনটি মামলা হয়েছে। একটি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজে), দ্বিতীয়টি হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট-আইসিসি) এবং তৃতীয়টি হয়েছে আর্জেন্টিনার আদালতে। আইসিসির মামলাটির বিচার প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গাতে তীব্র চাপের মুখে রয়েছে।

আইসিজের মামলায় লড়তে হেগে পৌঁছেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। এক সময় মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলেও তিনি এখন নিজ দেশে গণহত্যার দোসর। এবার তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইবেন। সু চির এ সিদ্ধান্তে তার অনেক আন্তর্জাতিক শুভাকাঙ্ক্ষীও হতাশ ও বিস্মিত হয়েছেন।

রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে আইসিজেতে মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়া। এতে কূটনৈতিক ও আর্থিক সমর্থন দিচ্ছে ওআইসি। মামলায় সমর্থন দিয়েছে আরও বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা। ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে মামলাটি দায়ের করা হয়। মিয়ানমার ও গাম্বিয়া উভয়েই এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী। ফলে মিয়ানমার এ মামলায় সাড়া দিতে বাধ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাম্বিয়ার মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আদালতে এবং এই মামলায় মিয়ানমারের বিচারের জন্য সবচেয়ে শক্ত আইনগত ভিত্তি রয়েছে।

মামলাটিতে দায়ের করা অভিযোগপত্রে ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও তাদের পরিকল্পিতভাবে উৎখাত করার দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি এবং ভিকটিমদের জন্য ক্ষতিপূরণের আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক আচরণ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করার নির্দেশ চাওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আইসিজেতে দায়ের করা মামলায় মিয়ানমারের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে নানা কারণে। প্রথমত, গণহত্যার অভিযোগের যথেষ্ট প্রমাণ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানী কমিশন, এর মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে। দ্বিতীয়ত, প্রায় তিন বছর আগে গণহত্যার ঘটনাটি ঘটলেও মিয়ানমার এর বিচারের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। গণহত্যা আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে এর বিচার রাষ্ট্র নিজে না করলে আন্তর্জাতিক আদালত এমনকি অন্য যে কোনো দেশের আদালত তা করতে পারেন। ফলে আইসিজের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে সফল হওয়ার সুযোগ মিয়ানমারের নেই।’

আইসিজেতে সু চির সঙ্গে থাকছেন একদল সিনিয়র আইনজীবী। বিশ্নেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে সু চির যে ভাবমূর্তি ছিল, তা আরও ক্ষুণ্ণ হতে চলেছে এবার। ২০১৬ সালে সু চি যখন পশ্চিম ইউরোপ সফরে যান, তখন তাকে বরণ করা হয়েছিল গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও আশা-ভরসার প্রতীক হিসেবে। আর এখন তার পক্ষে কেউ নেই। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার দায় তার ওপরও বর্তাচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো সু চির এবারের ইউরোপযাত্রাকে দেখছে ভিন্নমাত্রার এক সফর হিসেবে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ একবাক্যে বলে আসছে, রাখাইনে মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সু চি এর দায় এড়াতে পারেন না।

বিশ্নেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই জাতিসংঘের আদালতে লড়তে যাচ্ছেন সু চি। দেশের ভেতর অবস্থান আরও সুসংহত করাই তার মূল উদ্দেশ্য। আগামী বছর মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন ধরে রাখতে গণহত্যার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। গতকাল রোববার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হেগের উদ্দেশে যাত্রাকালে নেপিদো বিমানবন্দরে সু চিকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়।

তবে বিশ্নেষকরা বলছেন, সু চিকে হাসিমুখে দেখা গেলেও রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমার ভীষণ চাপে পড়েছে তিনটি মামলার কারণে। এতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আইসিজে, আইসিসি ও আর্জেন্টিনার আদালতে মামলা আর তদন্তের পদক্ষেপ মিয়ানমারের ওপর বড় পরিসরে চাপ তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এতদিন যারা জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে ভোট দেয়নি, কিংবা মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছে, তাদের প্রতি নতুন করে আহ্বান জানাতে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি হলো।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের মতে, বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়া মামলায় তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহায়তা করতে পারে ঢাকা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মিয়ানমারের বিষয়টি যেহেতু আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে, তাই জাতিগত নিধনের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিচারই যথেষ্ট নয়। জাতিগত নিধনের প্রস্তুতির বিষয়ে জানার পরও যারা ব্যবস্থা নেয়নি, তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে। জাতিসংঘকেও জবাবদিহি করতে হবে। কারণ তারা এই নিধনযজ্ঞের প্রস্তুতির বিষয়ে জেনেও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়নি।

সাক্ষী দিতে হেগে গেল রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল

আইসিজেতে সাক্ষী দিতে নেদারল্যান্ডস গেছে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল। শনিবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে তিনজনের প্রতিনিধি দলটি রওনা দিয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জন নারী। তারা দু’জনই মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ভিকটিম হিসেবে সেখানে তাদের সাক্ষী দেওয়ার কথা রয়েছে।

গতকাল দুপুরে বিষয়টি স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তবে তিনি বলেন, তারা কীভাবে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না তিনি।

রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) এক কর্মকর্তা বলেন, আইসিজের শুনানিতে অংশ নিতে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল নেদারল্যান্ডস যাচ্ছে। তারা গতকাল এখান থেকে রওনা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তাও বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার।

Print Friendly, PDF & Email