ধারাবাহিক প্রতিবেদন : দ্বিতীয় পর্ব

নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকের তালিকায় তৃণমূল প্রতিনিধি থেকে শীর্ষ পর্যায়ের সম্পাদক

এ আর মারুফ ◾

চলতি ২০২০ সালের প্রথমার্ধে হামলা, মামলা, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার ১৫৯ সাংবাদিকের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ের সংবাদকর্মী যেমন আছেন তেমনি রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক। আর নিপীড়কের তালিকায় সন্ত্রাসীদের সাথে পাল্লা দিয়ে রয়েছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে করোনাকালে এপ্রিল ও মে মাসে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে পুলিশের হাতে নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে বেশী।

লকডাউনকালে পেশাগত কাজে ঘর থেকে বের হয়ে পুলিশের নির্বিচার আক্রমনের শিকার হয়েছেন মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা। আবার করোনা মহামারিতে সরকারের খাদ্যসহায়তার চাল আত্মসাতের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ করে ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের রোষানরে পড়েন তৃনমূলের বহু সাংবাদিক। অনেককে পিটিয়ে, কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম ও রক্তাক্ত করা হয়।

দেশনিউজ ডটনেট-এর আর্কাইভ ও গবেষণা সেল থেকে প্রাপ্ত ছয় মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বছরের শুরুতে জানুয়ারিতে ২০ জন সাংবাদিক হামলা, নির্যাতন, মামলা ও হয়রানির মুখে পড়েন। এর মধ্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হকসহ সম্পাদক পর্যায়ের ৪ জনকে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। ৫ জানুয়ারি ঢাকার পত্রিকা অফিস থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকার সম্পাদক এমজি কিবরিয়া চৌধুরীকে।

জানুয়ারিতে নির্যাতন শিকার অন্য সাংবাদিকদের মধ্য রয়েছেন, চট্টগ্রামের যমুনা টিভির সাংবাদিক আসহাবুর রহমান শোয়েব সঞ্জয় মল্লিক, দৈনিক বিজনেস বাংলাদেশের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সজিব বনিক, একাত্তর টিভির খুলনা ব্যুরো প্রধান রকিব উদ্দিন, বাংলানিউজ২৪ ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার আবাদুজ্জমান শিমুল, যমুনা টিভির সাইফুদ্দিন রবিন ও সাঈদ খান প্রমুখ।

এছাড়া কালের কন্ঠের সম্পাদক সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা কামাল ও পত্রিকাটির রাজবাড়ি প্রতিনিধি, সময় টিভির বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ , প্রধান বার্তা সম্পাদক ও মাদারিপুর প্রতিনিধি, প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি রাজিউল ইসলাম রাজু হয়রানিমূলক মামলার জালে জড়ান জানুয়ারিতে।

ফেব্রয়ারি মাসে সবচেয়ে বড় সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ভোট গ্রহণের দিন। পয়লা ফেব্রুয়ারিতে ভোটগ্রহণকালে রাজধানীর নিকুঞ্জ, মোহাম্মদপুর, মাদারটেকসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০জন সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরে আগামী নিউজ২৪ ডটকমের সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমনকে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত করে। এ ছাড়াও হামলার শিকার সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাহবুব মমতাজি, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর নুরুল আমিন জাহাঙ্গীর, পিবিএ এজেন্সীর জিসাদ ইকবাল, কালের কন্ঠের শেখ হাসান, মাছরাঙা টিভির হাসনায়েন তানভীর ও সাইফুল ইসলাম, পরিবর্তন ডটকমের ওসমান গনি, দিন প্রতিদিনের পাপন প্রমুখ। ওই মাসে নির্যাতিত অন্য সাংবাদিকরা হচ্ছেন নিউজ টুয়েন্টিফোর টিভির ফখরুল ইসলাম ও শেখ জালাল, যুগান্তরের টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল প্রতিনিধি খান মো. ফজলুর রহমান ও মুন্সিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি গুলজার হোসেন।

মার্চ মাসে হামলা, মামলা, গুম, হয়রানি ও হুমকির সম্মুখিন হওয়া ছাড়াও মাসের দশ তারিখে অপহরণ ও গুমের শিকার হন বর্তমানে কারাবন্দী ফটো সাংবাদিক, মাসিক পক্ষকালের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল। মাসের শুরুতে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও পত্রিকার প্রতিবেদক আল-আমিনসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। ওই মামলার আসামী হিসেবে শফিকুল ইসলাম কাজল এখনও কারাবন্দী। কাজলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়।

আর মার্চে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা আরেক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে উত্তর জনপদের কুড়িগ্রামে। সেখানে বাংলাট্রিবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে রাতদুপুরে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ডিসি অফিসে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং মাদক মামলায় সাজা দিয়ে জেলে পাঠানোর ঘটনাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কয়েকদিন ধরে ফলাও প্রচার পায়। এতে চাপের মুখে পড়ে সরকার কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার, সাংবাদিককে জামিনে মুক্তি এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে বাধ্য হয়। একটি খাস পুকুর জেলা প্রশাসক নিজের নামে করার চেষ্টা এবং নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করে ডিসির রোষানলে পড়েন ওই সাংবাদিক।

এ মাসের শেষ দিনে আরেকটি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও বেশ আলোচিত হয়। ভোলার বোরহানউদ্দিনে বাংলাদেশ অনলাইন প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাগর চৌধুরীকে মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে চেয়ারম্যান পুত্র নাবিল চৌধুরী কর্তৃক মারধোরের ঘটনা ঘটে। ত্রাণের চাল তছরুপের ঘটনা ফাঁস করায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। তীব্র প্রতিবাদের মুখে চেয়ারম্যান পুত্র গ্রেফতার হন।

মার্চ মাসে হামলা, মামলা হয়রানির শিকার অন্য সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সাংবাদিক মাহবুবুল আলম লাবলু, বাংলাদেশ প্রতিদিনের মেহেরপুর প্রতিনিধি মাহবুবুল হক, কুমিল্লায় সময়ের আলোর স্টাফ রিপোর্টার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গাজীপুরের শ্রীপুরে দৈনিক নবরাজ-এর জামাল উদ্দিন, টঙ্গীতে দৈনিক নয়াদিগন্তের প্রতিনিধি শেখ আজিজুল হক ও ভোরের কাগজের প্রতিনিধি এম আর নাসির, মাদারিপুরে স্থানীয় সাংবাদিক সাবরিন জেরিন, আবদুল্লাহ আল-মামুন ও আরিফুর রহমান, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় দৈনিক দেশকাল পত্রিকার সাংবাদিক আবু বকর সিদ্দিক ও দৈনিক বাংলাদেশ কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার সুমন চৌধুুরী প্রমুখ।

[নির্যাতনের আরও চিত্র আগামীকাল তৃতীয় পর্বে]

ডিএন/জেএন/বিএইচ/১১ঃ০০এএম/০৭০৭২০২০-১

Print Friendly, PDF & Email