ভোটাদের মাঝে অজানা উৎকণ্ঠা, তবুও আজ ২৩৪ পৌরসভায় ভোট

vote-lineনিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাত পোহালেই আজ বুধবার দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ। প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারীর একতরফা জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে রয়েছে অজানা ক্ষোভ-হতাশা। ভোট আসলেই ভোটাররা উৎসব মুখর পরিবেশে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ব্যালটে ভোটারাধিকার প্রয়োগ করবেন,  যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করে খুশীর আমেজ এমন চিত্রই স্বাভাবিক। কিন্তু গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশে সেই চিত্রে যেন ভাটা পড়েছে। ভিন্ন মতের প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদ ও তাদের বাড়ি-ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, গুলি, হুমকি-ধমকি আর সন্ত্রাস-সহিংসতা, ভোট কেন্দ্রে যেতে ভোটারদের বাধা প্রদান, ভয়-ভীতি দেখানো, সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা এমন চিত্রই এখন বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিবেশের। এক কথায় বলতে গেলে ভোট সম্পর্কে মানুষের আগের সেই ধারণাই পাল্টে গেছে গত কয়েক বছরে। পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত টানা সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে নির্বাচনী এলাকায় উৎসবের পরিবর্তে আগের মতো সেই ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই রাত পোহালেই আজ বুধবার দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ। প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে এই নতুন নিয়মে অর্থাৎ স্থানীয় সরকারেও সরাসরি জাতীয় রাজনীতির প্রভাবটা কেমন তা দেখার অপেক্ষা। দীর্ঘ সাত বছর পর প্রধান দু’দলের ‘মর্যাদার’ লড়াইয়ে জন্য দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী।
যদিও ভোটাররা নিরাপদে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না এনিয়ে শুধু সন্দেহ-সংশয়ই নয়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও রয়েছেন তারা। আনন্দ-উৎসবের পরিবর্তে ভোটারদের মধ্যে এখন ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জানা গেছে, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং ভোটাররা নিরাপদে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও মানুষ তাদের কথায় কোনো ভাবেই আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ,  গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে সুষ্টু নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা ঘটেছিল সম্পুর্ণ বিপরীত। তাই, ভোটাররা এখন আর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের বুলি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।

বিশেষ করে সোমবার নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ যে আহ্বান জানিয়েছেন, এটার পর ভোটারদের মনে সন্দেহ-সংশয় আরও বেড়ে গেছে। তারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা শুধু কাগজে-কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সব কিছু চলছে সরকারের ইশারাতেই। নিরাপদে ভোট দেওয়ার সুষ্টু পরিবেশ সৃষ্টি বর্তমান কমিশনের পক্ষে সম্ভব না।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর করতে নির্বাচন কমিশন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সাংবিধানিক ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। নির্বাচন কমিশনের তাতে বোধোদয় হয়নি। বরং  প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনাররা নির্বাচন নিয়ে এমন কিছু আচরণ করেছে যা হাস্যকর বলে আখ্যায়িত হয়েছে বিশিষ্টজনদের কাছে।

পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করছেন যে, তাদের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার কাজে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা বাধা দিচ্ছে। প্রচারের মাইক ভাঙচুর ও পোস্টার ছিড়ে ফেলা হচ্ছে। প্রচারকর্মীদেরকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা মারধর করছে। গণসংযোগের সময় পুলিশ কর্মীদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশী তল্লাশির নামে তাদেরকে হয়রানি করছে। গ্রেফতারের ভয়ে প্রার্থীরা মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চাইতে পারছেন না। এমনকি প্রার্থীকে পর্যন্ত আহত-নিহত করা হয়েছে।

বিএনপির বক্তব্য হলো, ‘আমরা প্রথম থেকেই নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি সুষ্ঠু-অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আমাদের এসব অভিযোগ কোনো আমলেই নেয়নি। এতে তারা মুখে এখন যতই আশ্বাস দিক আদৌ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কি না, মানুষ ভোট দিতে পারবে কি না আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে।’

সরকারের চাপের কারণে যে নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন না এটা সকলের কাছেই স্পষ্ট।
আর এ কারণেই পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন তা করতে পারছে না বলে সচেতন মানুষ মনে করছেন।

কঠোর নিরাপত্তাঃ
এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা শাখার উপ-সচিব শামসুল আলম বলেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য মাঠে আছে বলে জানান শামসুল আলম। পুলিশ প্রায় ৪৫ হাজার, বিজিবি ৯ হাজার ৪১৫, র‌্যাব ৮ হাজার ৪২৪ কোস্টগার্ড ২২৫ আনসার ভিডিপি ৪৯ হাজার ৭২৮ এবং ব্যাটালিযন আনসার ৪ হাজার ৫১২ সব মিলিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০৪ সদস্য মাঠে থাকছে বলে ইসির এই উপ- সচিব জানান। এছাড়া সোমবার থেকে মাঠে রয়েছে ১ হাজার ২০৪ জন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

ভোটের দিন ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ জন ও সাধারণ কেন্দ্রে ১৯ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্বে থাকবে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ নির্বাচনে বিজিবি, কোস্ট গার্ড, র‌্যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা নির্বাচনী মাঠে থাকছে। ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পুলিশ, আনসার-ভিডিপি ও ব্যাটালিয়ন আনসার সার্বক্ষণিক থাকছে। এছাড়া মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে বিজিবি, র‌্যাব, এপিবিএন, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা নিয়োজিত থাকছে। এসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্বে ও অপরাধ দেখভালে রয়েছে নির্বার্হী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

এদিকে ভোটের আগের রাতে আগের মতো যাতে কেন্দ্র দখল যাতে না হয় সে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। তিনি আইনশৃঙ্খলা সভার কার্যবিবরণীতে বলেছেন, অতীতে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ও বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এজন্য নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। এতে সময় ও প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি আমাদের ব্যর্থতা। এবার যাতে ভোটের আগের রাতে কেন্দ্র দখল না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখার নির্দেশ দেন তিনি।

২৮ ডিসেম্বর সোমবার রাত ১২টার আগেই বহিরাগতদের (যারা ভোটার বা বাসিন্দা নন) নির্বাচনী এলাকা ত্যাগে নির্দেশ দেয়া হয়েছে একটি পরিপত্রে। এছাড়া ভোটের দুই দিন আগে থেকে পরবর্তী আরো চার দিন পর্যন্ত অস্ত্রের লাইসেন্সধারীরা যাতে অস্ত্রসহ চলাচল করতে না পারে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বৈধ লাইসেন্সধারীদের সবধরণের অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের গ্রেফতার ও ভোটের পরিবেশ নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন ও পুলিশকে বলা হয়েছে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন যতো প্রার্থী:
২৩৪ পৌরসভা নির্বাচনে ২০টি দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মেয়র পদে ৯৪৫ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছে। সাধারণ কাউন্সিলর ৮ হাজার ৭৪৬ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২হাজার ৪৮০ জন। তবে এদের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় মেয়র পদে ৭ জন এবং কাউন্সিলর পদে ৯৪ জন ও নারী কাউন্সিলর পদে ৪০ জন নির্বাচিত হয়েছেন।

মেয়র পদে ২০ দল ও সাড়ে ৯শ’ প্রতিদ্বন্দ্বী:
ইসির উপ সচিব সামসুল আলম জানান, এবার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের ২৩৪ জন, বিএনপির ২২৩ জন, জাতীয় পার্টির ৭৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী রয়েছে। দলীয় প্রার্থী ৬৬০ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে ২৮৫ জন। এতে অর্ধশতাধিক আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র বিদ্রোহীরা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

এছাড়া এলডিপি ১ জন, জেপি ৬ জন, সিপিবি ৪ জন, ন্যাপ ১ জন, ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ জন, বিকল্পধারা ১ জন, জাসদ ২১ জন, বাসদ ১ জন, তরিকত ফেডারেশন ১ জন, এনপিপি ১৭ জন, পিডিপি ১ জন, ইসলামী ঐক্যজোট ১ জন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ১ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৫৭ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৩ জন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ১ জন, খেলাফত মজলিস-এর ১ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছে।

ভোটার ও ভোটকেন্দ্র:
এ নির্বাচনে ৩ হাজার ৫৫৫টি ভোটকেন্দ্রে ভোট হবে। এসব ভোট কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা ২১ হাজার ৭১। এ হিসাবে প্রতি কেন্দ্রে ১ জন করে ৩ হাজার ৫৫৫ জন প্রিজাইডিং অফিসার, প্রতি বুথে ১ জন করে ২১ হাজার ৭১ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রতি বুথে ২ জন করে ৪২ হাজার ১৪২ জন পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মোট ভোটার রয়েছে প্রায় ৭১ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ২৮৪ জন এবং নারী ভোটার ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৮৬০ জন। ভোট গ্রহণ করবেন ৬৬ হাজার ৭৬৮ জন কর্মকর্তা।

মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত পদের ব্যালট পেপার, সিল, ফরম প্যাকেট ও অন্যান্য নির্বাচন সামগ্রী নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছেছে। এ নির্বাচনের মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত পদের ২ কোটি ১৩ লাখের বেশি ব্যালট পেপার, ভোট দেওয়ার সিলসহ নির্বাচন সামগ্রী পাঠিয়েছে ইসি। এসব পৌরসভায় মোট ভোটকেন্দ্রের এক-তৃতীয়াংশ ভোট কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ।

Print Friendly, PDF & Email