উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই ২৩৪ পৌরসভায় চলছে ভোট গ্রহণ

00001নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা শঙ্কার মধ্যেই শুরু হলো দেশের ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। বুধবার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে এবং তা চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এরপর বিকেল থেকে ফলাফল ঘোষণা শুরু হবে।

প্রথমবার দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে এসব পৌরসভার ৭১ লাখ মানুষ ভোটার হলেও ইতোমধ্যেই এ নির্বাচন অনেকাংশে জাতীয় নির্বাচনের মর্যাদা পেয়েছে। সাত বছর পর বাংলাদেশের মানুষ তাদের দুটো প্রিয় প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষ একই ব্যালটে দেখতে পাবেন।

তবে নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কা আর সহিংসতার অভিযোগ উঠছে বেশ জোরেশোরেই। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিই শুধু এ আশঙ্কা করছে না, সুশীল সমাজের তরফেও এসেছে একই অভিযোগ।

এ নির্বাচনে প্রায় ১২০০ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা,যা মোট কেন্দ্রের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। নির্বাচনী মাঠে ২ হাজারের বেশি সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে বলেও আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নির্বাচনে কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে ভোটারদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে পছন্দের প্রার্থীকে, কোনো সমস্যা হবে না। তবে শুরু থেকে বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসির এ আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না অনেকেই।

এদিকে নির্বাচনের আগের দিনও বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বাগযুদ্ধ চলেছে। উভয় দলই তাদের বক্তব্য ও অভিযোগ নিয়ে মঙ্গলবার ছুটে গিয়েছে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে। সেখানে দু’দলের নেতারা বৈঠক করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে ইসিতে বিএনপি প্রতিনিধি দলের বৈঠকের পরই সেখানে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। সে দলের নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ।

সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বিএনপি নেতা ড. মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে ভোটারদের মনের প্রতিফলন ঘটলে, জনগণ ভয়হীনভাবে খুশিমতো ভোট দিতে পারলে বিএনপি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে।

আর আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফ সিইসির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন কমিশনের কিছু পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের প্রতি নির্দয় হলেও সার্বিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির প্রতি তাদের আস্থা রয়েছে।

অন্যদিকে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ ভোটের ঠিক আগের রাতে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, পৌর নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষপাতিত্ব বরদাস্ত করবে না। কোনো অনিয়মের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মনিটরিং সেল গঠন

ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকিসহ সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করার জন্য সাত সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে ইসি। এ সেলের নেতৃত্বে রয়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন। সদস্য হিসেবে থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, একজন পুলিশ সুপার (এসপি) এবং বিজিবি, র্যা ব ও আনসার-ভিডিপির মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার অথবা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যায়ের কর্মকর্তা। এ বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব মো. সামসুল আলম বলেন, নির্বাচনের দিন এই সেল বা কমিটি ২৩৪টি পৌরসভার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করবে এবং তা ইসিকে অবহিত করবে।

বৈধ অস্ত্র প্রদর্শন নিষিদ্ধ

গত রাত ১২টার মধ্যেই বহিরাগতদের (যারা ভোটার বা বাসিন্দা নয়) নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভোটের দুই দিন আগে থেকে পরবর্তী আরো চার দিন পর্যন্ত অস্ত্রের লাইসেন্সধারীরা যাতে অস্ত্রসহ চলাচল করতে না পারেন সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বৈধ লাইসেন্সধারীদের সব ধরনের অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের গ্রেপ্তার ও ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন ও পুলিশকে বলা হয়েছে।

যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা

নির্বাচনী এলাকায় ভোটের আগের রাত অর্থাৎ আজ মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু করে মোট ৪৮ ঘণ্টা যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে ২৯ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ৩০ ডিসেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এরই মধ্যে এ নির্দেশনা জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় ২৭ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ইসির কর্মকর্তারা জানান, ইসি ও রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদিত পরিচয়পত্রধারী, নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। জাতীয় মহাসড়ক, বন্দর, জরুরি পণ্য সরবরাহ ও অন্যান্য প্রয়োজনে এ নিষেধাজ্ঞা শিথিল থাকবে।

আরো এক এমপিকে সতর্ক

এদিকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য গাজী এম এম আমজাদ হোসেনকে গতকাল সতর্ক করেছে ইসি। এ-সংক্রান্ত চিঠি ওই সংসদ সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর জানা যায়, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের এমপি হাসিবুর রহমান ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি আবু জাহিরকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য কড়া সতর্কবার্তা পাঠিয়ে বলা হয়, ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে নির্বাচন কমিশন বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।

এদিকে ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল নির্বাচন কমিশনাররা মৌখিকভাবে টেলিফোনে কয়েকজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচনী এলাকায় না থাকার পরামর্শ দেন। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা ওই সব সংসদ সদস্যের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা থামাতে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানালে নির্বাচন কমিশনাররা তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।

নিরাপত্তায় আইনশঙ্খলা বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য

এ অবস্থায় পৌর নির্বাচনের নিরাপত্তায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০৪ জন সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে। এর মধ্যে পুলিশ ৪৫ হাজার, বিজিবি ৯৪১৫ জন, র্যা ব ৮৪২৪ জন, কোস্টগার্ড ২২৫ জন, অঙ্গীভূত আনসার ৪৯৭২৮ জন এবং ব্যাটালিয়ন আনসার ৪৫১২ জন। ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিটি কেন্দ্রে ৮ জন অস্ত্রধারীসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর ২০ জন সদস্য মোতায়েন থাকবে। আর সাধারণ কেন্দ্রে ৭ জন অস্ত্রধারীসহ ১৯ জন সদস্য থাকবেন। প্রতিটি পৌরসভায় সোমবার সকাল থেকে পুলিশ, র্যা বও বিজিবির মোবাইল টিম টহল শুরু করেছে।
এছাড়া সোমবার থেকে মাঠে রয়েছে ১২০৪ জন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০টি দল

কমিশনের তথ্য মতে, ২৩৪ পৌরসভায় ১২১৭১ জন প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে ৯৪৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৮ হাজার ৭৪৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২ হাজার ৪৮০ জন প্রার্থী হয়েছেন। ২৩৪টি পৌরসভায় ২৩৪টি মেয়র, ৭৩১টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর ও ২ হাজার ১৯৩টি সাধারণ কাউন্সিলর পদ রয়েছে। এরই মধ্যে ৭ জন মেয়র, ৯৪ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৪০ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলরসহ মোট ১৪১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। নির্বাচিতদের সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

অভিযোগ রয়েছে, এসব এলাকায় সরকারি দলের বাধার মুখে অন্য দলগুলোর প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ কারণে একক প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

এ নির্বাচনে ২০টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৩৪ জন, বিএনপি ২২৩ জন, জাতীয় পার্টির ৭৪ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ২১ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১৭ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৫৭ জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ৮ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ৬ জন, কমিউনিস্ট পার্টির ৪ জন, খেলাফত মজলিসের ৪ জন, ইসলামী ফ্রন্টের ৩ জন এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ইসলামী ঐক্যজোট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও খেলাফত মজলিসের একজন করে প্রার্থী রয়েছেন।

তবে ভোটের আগেই ৭টি পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। পৌরসভাগুলো হচ্ছে পিরোজপুর, মাদারগঞ্জ, টুঙ্গীপাড়া, ফেনী, পরশুরাম, চাটখিল ও ছেংগারচর। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনে ২৮৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। নিবন্ধন স্থগিত থাকায় জামায়াতে ইসলামীর নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের ৬৮ জন ও বিএনপির ২৬ জন বিদ্রোহী প্রার্থী সক্রিয় রয়েছেন। দলীয় প্রার্থী জয়ের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হচ্ছে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। এরই মধ্যে বেশ কিছু পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতাও হয়েছে।

ভোটার ও ভোটকেন্দ্র

ইসি জানায়, পৌর নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ২৮৪ জন ও মহিলা ৩৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬০ জন। ২৩৪ পৌরসভায় ৩,৫৫৫টি ভোটকেন্দ্রে একযোগে ভোট হবে। এসব ভোটকেন্দ্রে বুথের সংখ্যা ২১,০৭১টি। নির্বাচনে ৬৬,৭৬৮ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার নিয়োগ চূড়ান্ত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ৩৫৫৫ জন ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ২১,০৭১ জন, পোলিং কর্মকর্তা ৪২,১৪২ জন।

Print Friendly, PDF & Email