বিজয়ের মাস

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দৃশ্যমান হতে থাকে

মাহবুবা সুলতানা কলি |

আজ বিজয় মাসের দ্বিতীয় দিন। একাত্তরের রক্তঝরা এ দিনে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। সময়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দৃশ্যমান হতে থাকে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়রথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিংস্র হানাদার বাহিনী। পাক-হানাদার বাহিনী নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাংলার দামাল ছেলেরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেন বিজয়ের স্বর্ণশিখরের দিকে। পাকবাহিনীর সব পরিকল্পনা একে একে ভেস্তে যেতে থাকে। বাংলার আকাশে ধীরে ধীরে উঁকি দিতে থাকে বহুল কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের লাল সূর্য।

ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, পরাজয়ের আভাস পেয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান একাত্তর সালের ২ ডিসেম্বর মরিয়া হয়ে তাদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি পাঠান। ইয়াহিয়া চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সীমান্ত এলাকায় পাক জান্তারা সমরসজ্জা বাড়ানোয়

ভারতও তা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়।

ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখেশুনে ভারত সরকার বুঝেছিল, পাকিস্তান যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্তুতিও চালিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজে লোক ধরা পড়ার সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলে যে, পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না। বরং লড়াই-ই করবে। তাই তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতি আরও জোরদার হয়।

বাংলাদেশের (তখন পূর্ব পাকিস্তান) পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বিবিসিতে সবিস্তারে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহমদ। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার ৫টি স্থানে বোমা বিস্ফোরণের খবর তিনি জানান। রামপুরা ও মালিবাগে বিস্ফোরণে বিদ্যুত সরবরাহের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সংবাদও তিনি জানান।

ডিসেম্বরের শুরুতে বসন্তপুর, কালীগঞ্জ, নাছিমগঞ্জ, পারুলিয়া ইত্যাদি এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটিয়ে মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। রূপসা নদীর ওপারে খুলনার কাছে ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেক দল। দেশের গভীরতম স্থানেও যে মুক্তিবাহিনী ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল, এর প্রমাণ নানা স্থান থেকে মিল ছিল। নাগরপুর থানা মুক্ত হওয়ার ফলে টাঙ্গাইলে আক্রমণ পরিচালনা হয়ে পড়ে অত্যাসন্ন। সিলেটে শমসেরনগর বিমানবন্দরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা দল। বিবিসি, ভোয়া, আকাশবাণী অথবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদে উচ্চারিত বিভিন্ন স্থানের নাম কোটি মানুষের বুকে জাগাতো অন্যতর অনুভূতি। একেকটি জনপদ মুক্ত হয়ে আলোড়ন তুলতো হাজারো জনপদবাসীর অন্তরে।

২ ডিসেম্বর সীমান্ত-সংঘাত আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তান অভিযোগ করেছিল যে, ৭টি স্থানে ভারত যুদ্ধের ফ্রন্ট খুলেছে এবং তাদের প্রতিরোধ বু্যহে আঘাত হেনেছে। এমনি এক গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছিল দিনাজপুরে, যদিও সেই পরাভবের স্বীকারোক্তি দিতে পাকিস্তান তখনো প্রস্তুতি ছিল না। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে ভারতীয় সেনাদল পঞ্চগড় মুক্ত করে এগিয়ে চলছিল ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে। তবে এমনি নির্বাচিত রণক্ষেত্রে ভারতীয় অংশগ্রহণ ছিল সীমিত আকারে। সীমান্ত পেরিয়ে হট পারসুইট বা হানাদারদের তাড়িয়ে দেয়ার মতো করে পরিচালিত হচ্ছিল অভিযান; ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় যুদ্ধাবস্থা হলেও প্রকৃত যুদ্ধ এ নয়। সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ লিখেছিলেন, ৬০০ থেকে ৮০০ সেনা নিয়ে ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পরিচালিত হচ্ছে ভারতীয় হামলা, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আক্রমণ ঘটছিল কোম্পানি পর্যায়ে (১২০ সদস্যবিশিষ্ট)। সীমান্তবর্তী বিশেষ কয়েকটি অঞ্চলে ঘটে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর ভারতীয় ভারী কামানের গোলাবর্ষণ। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে ভুল হয়নি গোলন্দাজদের। কামানের গোলায় সীমান্তবর্তী পাকিস্তানিদের অবস্থান ক্ষেত্রে কেঁপে উঠছিল মুহুর্মুহু, আর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ অভিযানে গোটা বাংলাদেশে পাকিস্তানি অবস্থান হয়ে উঠছিল থরহরি কম্পমান।

Print Friendly, PDF & Email