প্রশাসনের সালতামামি

তিন নারী কেলেঙ্কারি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ছড়াছড়ি আর দেদারসে পদোন্নতি

এবিএন হুদা |♦|

ঘটনাবহুল ২০১৯ সালে প্রশাসনে বহুল আলোচিত সরকারি চাকরি আইন কার্যকর ও কর্মচারী নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এছাড়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পছন্দের একান্ত সচিব (পিএস) না দেয়া উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে বড় দিক হল- বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি হয়েছে দেদারসে ।

তবে চুক্তি থেকে মুক্তি মেলেনি প্রশাসনের। বছরজুড়েই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ছড়াছড়ি ছিল। অপরদিকে বিদায়ী বছরে কিছু নেতিবাচক ঘটনাও ঘটেছে; যা বছরজুড়েই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এর মধ্যে জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীর ও দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলম এবং সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ ইমতিয়াজের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে প্রশাসনের নানা বিষয় পর্যালোচনায় এমন সব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে ৭ জানুয়ারি । একই সঙ্গে প্রশাসনেরও একটি বছর পূরণ হলো। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন মেহেরপুর-১ আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন। পূর্ণমন্ত্রী না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি কমাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের একান্ত সচিব (পিএস) নিয়োগ দেয়া হয়। আগে মন্ত্রিসভার সদস্যদের অভিপ্রায় ও পছন্দ অনুযায়ী পিএস পদে ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হতো।

বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত সরকারি চাকরি আইন কার্যকর হওয়ায় স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর জনপ্রশাসন একটি পূর্ণাঙ্গ আইন পেয়েছে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে অভিন্ন বিধিমালা জারি করা হয়েছে। এর ফলে এসব পদে নিয়োগে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। এক বছরে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে ৩৩৬ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ইতিবাচক ধারায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে বলে দাবি সরকারের । তবে তাদের এখনও উপযুক্ত জায়গায় পদায়ন সম্ভব হয়নি। পদোন্নতি পাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তা আগের জায়গায় ‘ইনসিটু’ হয়ে কাজ করছেন। তবে আগের মতোই চোখে পড়ার মতো বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদসহ প্রায় দেড় শতাধিক কর্মকর্তা চুক্তিতে কর্মরত রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

বিদায়ী বছরে কিছু নেতিবাচক ঘটনায় প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নারী অফিস সহায়কের সঙ্গে জামালপুরের তৎকালীন ডিসি আহমেদ কবীরের ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড এবং ২৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের দুটি ভিডিও ২২ আগস্ট রাতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিওতে তাদের বেসামাল অবস্থায় দেখা যায়। এ ঘটনায় জামালপুরসহ সারা দেশে নিন্দার ঝড় উঠে। ২৫ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাকে ওএসডি করে। ভিক্ষুকমুক্ত জেলা গড়ে প্রশংসা কুড়ানো কবীর সততার জন্য বিভাগীয় ‘শুদ্ধাচার’ পদক পেয়েছিলেন। কিন্তু নারী কেলেঙ্কারির পর তা কেড়ে নেয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে বরখাস্ত করা হয়।

জামালপুরের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলমের বিরুদ্ধে এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ উঠে। অক্টোবরে এক ভিডিও বার্তায় ডিসির সঙ্গে নিজের অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য ওই নারী ফাঁস করে দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিও বার্তায় ওই নারী দাবি করেন, ডিসি মাহমুদুল বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই ফাঁদে পা দিয়ে সংসার ভেঙেছে তার। নিপীড়নের শিকার হওয়া ওই নারী এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং দিনাজপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। জামালপুরের ডিসির নারী কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পরপরই ডিসি মাহমুদুল ওই নারীকে ভিডিও কল রেকর্ড, মোবাইল ফোন কল রেকর্ডসহ সব তথ্য মুছে দিতে বলেন। বিষয়গুলো কাউকে জানালে তাকে চাকরিচ্যুৎ করার পাশাপাশি রাজাকারের সন্তান সাজানোরও হুমকি দেয়া হয়। এমনকি তাকে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়া হয়। এরপর ওই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ডিসি মাহমুদুল। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) আ. গাফফার খান। তবে ডিসি মাহমুদুল বহাল তবিয়তেই আছেন।

এসব ঘটনার মধ্যেই তাহিরপুরের ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠে। তার প্রতারণার বিচার চেয়ে ৫ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন এক নারী। তার দাবি, ইউএনওর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং তার চাপে ৮ জুন রাতে তিনি গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি জানান, গত বছরের এপ্রিলে ঢাকায় আসিফের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ও আবাসিক হোটেলে থেকেছেন। তার কাগজপত্র ব্যবহার করে ঋণ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে আসিফ চট্টগ্রামের কদমতলীতে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে একটি হিসাব খোলেন। ওই হিসাবে তিনি আয়বহির্ভূত লাখ লাখ টাকার লেনদেন করেছেন। তখন চট্টগ্রামের ডিসি অফিসের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার পদে (এলএও) তিনি কর্মরত ছিলেন। আসিফের বিরুদ্ধে প্রেমের নামে এক নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো এবং ব্যাংক হিসাব খুলে আয়বহির্ভূত লাখ লাখ টাকা লেনদেন করার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে একজন কর্মকর্তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সিভিল সার্ভিসের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর আসিফকে আইসিটি বিভাগের কন্ট্রোলার অব ডিজিটাল সার্টিফাইং অথরিটি বিভাগে সহকারী নিয়ন্ত্রক পদে বদলি করা হয়। তবে এমন কর্মকর্তাকে গ্রহণ করেনি আইসিটি বিভাগ। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচের কর্মকর্তা আসিফকে ওএসডি করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email