করোনায় ২৩ চিকিৎসকের মৃত্যু, আক্রান্ত ১০১৬

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে থেকে লড়ছেন চিকিৎসকরা। করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরাও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে বা উপসর্গ নিয়ে প্রাণও হারিয়েছেন অনেক চিকিৎসক।

চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিসের (এফডিএসআর) হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১ হাজার ১৬ জন চিকিৎসককে শনাক্ত করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮ জন চিকিৎসক। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও পাঁচ জন চিকিৎসক। অর্থাৎ প্রমাণিত করোনায় ও উপসর্গে মোট ২৩ জন চিকিৎসক হারিয়েছে দেশ। এর মধ্যে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে করোনায় মারা গেছেন বিএসএমএমইউর ইউরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ এস এম গোলাম কিবরিয়া।

এফডিএসআর সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে ১৮ জন চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আরও পাঁচ জন।

চিকিৎসকদের সংক্রমিত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘রোগী দেখতে গিয়ে হয়তো যে কোনোভাবেই হোক চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে পারেন। চিকিৎসকদের তো রোগীকে দেখতে হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এ ছাড়াও, অন্য যে কোনোভাবেও চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে পারেন। আসলে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ নিরাপত্তাকর্মী যারা আছেন পুলিশ, আনসার অনেকেই ঝুঁকিতে আছেন। তারাও সংক্রমিত হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে (করোনার সংক্রমণের) যেমন পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) নিয়ে অভিযোগ ছিল। পিপিই তো চিকিৎসকদের জন্য অত্যাবশ্যক। পিপিই বলতে মাস্ক, মাথার ক্যাপ, গাউন, গ্লাভস, ফেস শিল্ড, আই শিল্ড— এসব যেন চিকিৎসকরা খুব সতর্কতার সঙ্গে পরে। এটা তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যদি তাদের এগুলো না দেওয়া হয়, তাহলে তো তারা ভয় পাবেন এবং রোগী দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। তারা যাতে এগুলো ঠিকমতো পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

‘চিকিৎসক-নার্স সবাইকেই সচেতন হতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা-সুরক্ষার স্বার্থে অবশ্যই যাতে তারা সুন্দরভাবে ও ভালো করে পিপিই পরে নেন। কারণ, দিনকে দিন যে হারে রোগী বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। চিকিৎসকরা যদি আক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে তো তারা রোগীকে সেবা দিতে পারবেন না। তখন রোগীরা আরও বেশি ঝামেলায় পড়বেন। একটা সংকট তৈরি হতে পারে। তাই রোগীদের স্বার্থেই চিকিৎসকদের সুরক্ষা আরও নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি হোক, সব হাসপাতালের জন্যই এটি সবচেয়ে জরুরি’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, ‘গত ১ জুন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। যেটা আমরা আরও আগে থেকে ধারণা করেছিলাম। আমার ধারণা, বেশকিছু মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে কোনো উপসর্গ নেই, কিন্তু তাদের মধ্যেও করোনার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এখন এসব বিষয় দেখতে হবে, দৈনিক কতজন করোনার হটলাইন নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করছেন এবং কতজনের পরীক্ষা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘করোনাকালে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। আমাদের সংক্রামক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও অতটা শক্তিশালী না। আমাদের শুধুমাত্র সংক্রামক রোগের জন্য আলাদা কোনো হাসপাতালও নেই। এখন তো করোনার কারণে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল করা হচ্ছে। এই অবস্থায় সব চিকিৎসককে এক করতে হবে। এই মহামারিতে তারাই ফ্রন্টলাইনার। কাউকে আলাদা না ভেবে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এরপর কোভিড-১৯ ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে। তবে, সবার আগে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সবার ক্ষেত্রেই সুরক্ষা প্রথম বিবেচ্য বিষয়।’

‘সর্বোপরি আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। কারণ, একা এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কেউ একা নিজেকে সচেতন রাখলে এই রোগ ঠেকানো যাবে না। তাই সবাইকেই সচেতন হতে হবে’, বলেন ডা. এম এ ফয়েজ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যেসব চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা মারা গিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। হাসপাতালে কাজ করতে যেয়ে তারা আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসকরা তো এমনিতেই সচেতন। তারা তো কোনো গাফিলতি করছেন না। কাজের মধ্যেই হয়তো দুর্ঘটনাবশত কোনো কারণে তারা সংক্রমিত হয়েছেন। কোনো সময় এমনো হয়ে থাকতে পারে যে, তাড়াহুড়োর কারণে তারা পিপিই ব্যবহারের সুযোগই পায়নি।’

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা তো ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা। তাদেরকে খুবই সতর্ক হতে হবে। আরেকটা ব্যাপার, হাসপাতাল ছাড়াও চিকিৎসকরা যদি অন্য কোথাও যান, তাহলেও যাতে পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেই যান।’

‘আমাদের দেশে অনেক ধরনের মানুষ রয়েছেন। কেউ কেউ সচেতন, সজাগ। কেউ কেউ সচেতনই নয়, জানেনই না। অনেকে হয়তো জানেন, কিন্তু সচেতন হচ্ছেন না। আবার অনেকে জেনেও মানতে চাইছেন না। এমন বহু ধরনের মানুষ রাস্তাঘাটে ঘোরাফেরা করছেন। যেহেতু চিকিৎসকদেরও বাইরে যেতে হয়, তাই সবমিলিয়ে আরও সচেতন হতে হবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম চিকিৎসক হলেন— সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এরপর গত ৩ মে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান। গত ১৩ মে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অধ্যাপক ডা. আবুল মোকারিম।

১৮ মে মারা যান ডা. আজিজুর রহমান রাজু, ২২ মে মারা যান মৌলভীবাজারের প্রাক্তন সিভিল সার্জন ডা. এমএ মতিন, একই দিনে মারা যান ডা. কাজী দিলরুবা খানম, ২৬ মে মারা যান সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রহমান, একই দিনে মারা যান গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আমিনা খান, ২৭ মে মারা যান অধ্যাপক ডা. মোশাররফ হোসেন, ৩০ মে মারা যান ডা. সাইদুর রহমান।

১ জুন মারা যান যক্ষ্মারোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াহিদুজ্জামান আকন্দ বাবলু, ২ জুন মারা যান প্রখ্যাত ইউরোলজিস্ট ডা. মঞ্জুর রশীদ চৌধুরী, ৩ জুন মারা যান চট্টগ্রামের মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. এহসানুল করিম। একই দিনে মারা যান ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন ও ডিজি হেলথের অবসরপ্রাপ্ত ইভালুয়াটার অফিসার ডা. একেএম ওয়াহিদুল হক।

৪ জুন মারা যান ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মুহিদুল হাসান।

আর করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া পাঁচ চিকিৎসক হলেন— অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম, অধ্যাপক (অব.) আনিসুর রহমান, ডা. সারওয়ার ইবনে আজিজ, ডা. জাফর রুমি ও ডা. তাজউদ্দিন।

উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৫৭ হাজার ৫৬৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মারা গেছেন ৭৮১ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ১৬১ জন।

Print Friendly, PDF & Email