এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে সংসদের আইনী পদক্ষেপ চান বিশিষ্টজনেরা

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী ◼

প্রাণঘাতী করোনা মহামারীকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন মানবপাচার ও অর্থপাচারের দায়ে কুয়েতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের আটক ও রিমান্ডের ঘটনা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্রেই এখন আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশের এমপি অপকর্ম করে বিদেশে গ্রেফতার। এনিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা অজ্ঞাত ছিলেন কাজী শহীদ পাপুল। নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন। এমনকি নির্বাচনের পর এমপি পাপুল তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য বানাতে সক্ষম হন।
তবে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবই হয়েছে তার অর্থের জোরে। নির্বাচনে তিনি অঢেল টাকা খরচ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না এটা প্রমাণিত হয়েছে। অনেক আগ থেকেই এমপি পপুল বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। অনেকে এসব জানলেও রহস্যজনক কারণে কেউ তাকে কিছু বলে না। কিন্তু বিদেশিরাতো আর মামু-খালু বুঝে না।

এমপি পাপুলের ফেসবুক ও ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপ অব কোম্পানিজ, কুয়েত, ওমান ও জর্ডানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানটি জনশক্তি রপ্তানিতে যুক্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জনশক্তি রপ্তানির আড়ালেই এমপি পাপুল মানবপাচার ও বিদেশে অর্থপাচার করে আসছেন। পাপুলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচারের অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে। দুদক ইতিমধ্যে তদন্তও শুরু করেছে। দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য তদন্তের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়েতের গণমাধ্যমে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তিন বাংলাদেশিকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর আলোচনায় আসেন এমপি পাপুল। কিন্তু ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিদেশি গণমাধ্যমের এসব সংবাদকে ফেইক নিউজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। যদিও এখন তিনি বলছেন-একজন সংসদ সদস্য বিদেশে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় আমরা লজ্জিত।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য অপকর্মের দায়ে বিদেশে গ্রেফতার হওয়া দেশের জন্য খুবই লজ্জার বিষয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এমপি পাপুলের কারণে দেশের অন্যান্য সংসদ সদস্যদের ব্যাপারেও এখন বিদেশিদের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষায় সরকারের উচিত হবে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা।


এ বিষয়ে কথা বললে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বুধবার সন্ধ্যায় দেশনিউজকে বলেন, বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য অপরাধের দায়ে বিদেশে গ্রেফতার ঘটনা খুবই বিব্রতকর। এটা দেশ, জাতি ও রাজনীতির জন্যও বিব্রতকর ঘটনা। কালো টাকার মালিকরা রাজনীতিতে আসার কারণেই মূলত এসব ঘটনা ঘটছে। দুর্নীতিবাজ ও অবৈধভাবে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই আজ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এমপি পাপুল যেহেতু একজন সংসদ সদস্য তাই তার বিষয়ে সংসদের কোনো ভূমিকা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবশ্যই সংসদের ভূমিকা রাখার বিষয় আছে। তার ঘটনা দেশের সংসদের জন্যও বিব্রতকর। সংসদের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। সংসদের আত্মমর্যাদা রক্ষায় সংসদের পক্ষ থেকে তার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। স্পিকার এবিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এমপি আটক হওয়ার ঘটনা যেদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তখনই এনিয়ে সংসদের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল।

এমপি পাপুলের বিষয়ে সংসদে আলোচনা ও আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা দরকার বলে মনে করেন আরেক রাজনীতিক বিশ্লেষক, আইনজ্ঞ ও সাবেক জজ ইকতেদার আহমেদ। দেশনিউজকে তিনি বলেন, মানবপাচার ও অর্থপাচারের দায়ে একজন এমপি বিদেশে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা সংসদের জন্য অপমানজনক। এনিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া দরকার। সংসদের বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা উচিত।

তিনি বলেন, এমপি পাপুল যে দেশে গ্রেফতার হয়েছেন সেই দেশের আইন অনুযায়ীই তার বিচার হবে। তারা তাদের আইন অনুযায়ীই গ্রেফতার করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখেছি ওই এমপি মানবপাচার ও অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। তিনি ১৮শ’ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। একজন সংসদ সদস্য দেশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি সংসদ ও এলাকার প্রতিনিধি। মানবপাচার আর অর্থপাচারের দায়ে বিদেশে তার গ্রেফতারের ঘটনা দেশের জন্যও লজ্জাকর।

ইকতেদার আহমেদ বলেন, গত নির্বাচনের আগেও এমপি পাপুল রাজনীতির বাইরে ছিলেন। শুধু কালো টাকার প্রভাবেই আজকে রাজনীতিতে তার এ অবস্থান। অর্থের প্রভাবে নিজে এমপি হলেন এবং স্ত্রীকেও এমপি বানালেন। এখন রাজনীতিতে নীতির চেয়ে অর্থের প্রভাব বেশি। অর্থের প্রভাবে যারা রাজনীতি করে তাদের দ্বারা জনকল্যাণ হবে না।

ডিএন/ইএন/জেএএ/বিএইচ

Print Friendly, PDF & Email