ভালমন্দের দায়ভাগ মুক্তিযোদ্ধা খোকাকেও বইতে হবে

♦ ফরহাদ মযহার ♦

ছাত্র ছিলেন তখন, টগবগে বয়েস। খোকা। মাত্র উনিশ বছর। অকুতোভয় তরুণ। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে চলে গেলেন। দুর্ধর্ষ সাহসী ছিলেন। বিজয়ী হয়ে ফিরেছেন। এখন ক্যন্সারের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হেরে গেলেন।

রাজনীতি করেছেন সারাজীবন। অতএব তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর কথাবার্তা হতেই পারে। হবে। হওয়া উচিত। কারণ যে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতো বাংলাদেশের রাজনীতির ভালমন্দের দায়ভাগ মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকাকেও বইতে হবে।

কিন্তু সবার আগে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য বুঝিয়ে দিন। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানান। উঠুন, সটান দাঁড়িয়ে অভিবাদন দিন। একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনাবসান হয়েছে। বিদায় সাদেক হোসেন খোকা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতির ইতিহাসে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

কিন্তু যে দেশ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হানাদারমুক্ত ও স্বাধীন করেছেন, সেই দেশের মাটিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন নি। নিউইয়র্কের একটি ক্যান্সার হাসপাতালে সাদেক হোসেন খোকা শেষ বারের মতো নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ তিনি বিরোধী দলের রাজনীতির একজন সামনের সারির নেতা। নিজ দেশে তাঁর লাশের জায়গা হবে কিনা, সেটা আমরা এখনও নিশ্চিত জানি না। অতএব শরমিন্দা বোধ করুন। এই এক দেশ যেখানে মানুষ তাদের লজ্জা ও বিবেক হারিয়েছে বহু আগে।

সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার অনেক বারই দেখা হয়েছে। কথাবার্তা হয়েছে। তিনি শক্তিশালী সংগঠক। আমার নিজেরই তাঁকে জানা বোঝার আগ্রহ ছিল বিপুল। এটা সত্য এবং সঙ্গত যে মুক্তিযোদ্ধা হবার কারনে তিনি জামাতের সঙ্গে বিএনপির জোট বাঁধা ভাল চোখে দেখতেন না। তবে সংসদীয় রাজনীতিতে কৌশলগত মৈত্রীতে আপত্তি ছিল মনে হয় নি। সফল সংগঠক ছিলেন বলে কৌশলের মূল্য বুঝতেন। তিনি বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিশাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; তাঁর হাতে গড়া দলে মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্ত বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাংখাই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। জামাতে ইসলামির প্রশ্ন বাদ দিলে সাধারণ ভাবে বাংলাদেশে ইসলাম ও রাজনীতির সম্বন্ধ নিছকই সংসদীয় কৌশল নয়, নীতিগত প্রশ্ন। অর্থাৎ সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা একটি গুরুতর প্রশ্ন। বিএনপি এই প্রশ্ন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়াতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী দল হিশাবে প্রচারণা চালাতে পেরেছে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার অস্বস্তি ছিল।

ব্যক্তি হিশাবে মিশুক ছিলেন। বন্ধু বৎসল। ঢাকাইয়াদের মতো অতিথিপরায়ন। তাঁর প্রতি আমার নৈকট্য বোধ করবার কারণ ছিল। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দিয়ে রাজনীতির পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেছেন। বিএনপিতে এসেছেন আশির দশকে।

সাদেক হোসেন খোকার প্রতি আমা্র আগ্রহের আরেকটি কারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে তাঁর দৃঢ়তা ও ভুমিকা। ১৯৯০ সালের দিকে বাবরি মসজিদ ভাঙা কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙার পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হয়। সেই চেষ্টা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সাদেক হোসেন খোকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পুরান ঢাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা ও ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভূমিকা নির্ধারক ছিল বলে মনে হয়।

বিএনপির ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি হিশাবে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর দৃশ্যমান উত্থান ঘটে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তাঁর দল সরকার গঠন করলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। তবে ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল সরাসরি নির্বাচনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের মেয়র হিশাবে দায়িত্ব পালন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

তিনি রাজনীতিতে চমক লাগিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে। ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে বিএনপির মনোনয়নে জয়ী হয়ে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হারিয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। এর পর তাকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন।

আপনাকে সশ্রদ্ধ বিদায় জানাচ্ছি, সাদেক হোসেন খোকা। বাংলাদেশ আপনাকে মনে রাখবে।

# ফরহাদ মযহারের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে

Print Friendly, PDF & Email