বিএনপি খবর রাখে?

নয়াপল্টনের সেই পাগলা রিজভী

কাফি কামাল |

রিজভী হাওলাদার ওরফে পাগলা রিজভীর সাথে আমার পরিচয় ওয়ান ইলেভেনের সময়। রাজনীতির এক দু:সময়ে। সেই থেকে বছরের পর বছর। একজন মানুষ কিভাবে বিএনপি তথা জিয়া পরিবারকে ভালোবাসতে পারে রিজভী তার একটি অনন্য উদাহারণ হয়ে উঠেছিল।

২০১৫ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তাল, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন গৃহবন্দী এবং অফিসবন্দি তখন দিনের পর দিন গায়ে কাফনের কাপড় জড়িয়ে গুলশান কার্যালয়ের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতো সে। মিছিল-মিটিংয়েও তাকে দেখা যেতো এই বেশে। কতবার তাকে পুলিশ লাঠিপেঠা করেছে, ভ্যানে তুলেছে তার ইয়াত্তা নেই।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নুর হোসেনের মতো বুকে-পিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”, “খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই”, “জেলে নিলে আমায় নে, আমার মাকে মুক্তি দে”- ইত্যাদি লেখাসহ মিছিল মিটিংয়ে সর্ব উপস্থিতি ছিল তার। খালেদা জিয়াকে যখন উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিচার ও সাজানো রায়ে কারাগারে পাঠানো হলো তখন সে একদিন প্রিয় নেত্রীর জন্য সামান্য কিছু ফল নিয়ে কারাফটকে হাজির হয়েছিল। সে ফল সামান্য হলেও তার মমত্ব ছিল অসামান্য। বহু লোক তো বিএনপির রাজনীতি করে কাড়ি কাড়ি টাকা বানিয়েছে, তারা কেউ কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্য সামান্য ফল নিয়ে যাবার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনি।
পাগলা রিজভীর কোন আয় উপার্জন ছিল না। চাইলে সে আয় উপার্জন করে দু-চারটা ডালভাত নিশ্চয় যোগাড় করতে পারতো। রিজভী সংসার করেনি। ঠিক মতো খেতে পেতো না। চিকিৎসাও নিতে পারতো না। তার চামড়া ঝুলে পড়া হাড্ডিসর্বস্ব শরীরটা দেখলেই সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু খেয়ে না খেয়ে সে পড়ে থাকতো নয়াপল্টনে। শীত-বর্ষা নেই, হরতাল-অবরোধ, পুলিশের পিটুনি আর গ্রেপ্তারের ভয় তাকে নয়াপল্টন থেকে সরাতে পারেনি। নয়াপল্টন কার্যালয়ের একটি অংশ হয়ে উঠেছিল রিজভী। দু’বেলা খাবার যোগাড়ের জন্য সে হাসিমুখে, খুবই নিচুকণ্ঠে, ভদ্রভাবে সে নেতাদের কাছে দু’দশ টাকা চাইতো। তার চাওয়া ছিল খুবই সীমিত। সবাই যে তার সে আবদার রাখতো তা নয়। আমি বহুবার দেখেছি অনেকেই তাকে বকাঝকা করছে। সে বকাঝকা শুনে যোগাড় করা টাকা থেকে বাচিয়ে সে ব্যানার-ফেস্টুন প্রিন্ট করতো।

জিয়া পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করে দুটি ব্যানার প্রিন্ট করে একটি গুলশান কার্যালয়ের সামনে ও অন্যটি নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে টাঙিয়েছিল সে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে ফেস্টুন প্রিন্ট করে বুকে পিঠে ঝুলিয়ে সে বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নিতো। নেতাদের কাছে ১০-২০ টাকা নিয়ে প্রিন্ট করতো সেসব ব্যানার ফেস্টুন।

নয়াপল্টনে গেলে বলতো, ভাই ম্যাডাম কি মুক্তি পাবে না। নেতারা সব দালাল হয়ে গেছে, তারা ম্যাডামের মুক্তির জন্য কিছু করছে না। বলতো- ভাই, দালাল নেতাদের বিরুদ্ধে নিউজ করেন। তারেক রহমান সাহেব জানুক, নেতারা সব বিক্রি হয়ে গেছে। আমি কখনো হাসতাম, কখনো বা উত্তরবিহীন নীরব। নেতারা নিজের স্বার্থে সাংবাদিকদের সাথে মিষ্টি ব্যবহার করে। সাংবাদিকদের কাছে রিজভীর পাবার কিছু ছিল না। তারপরও বিএনপি অফিসে বা নয়াপল্টনে কর্মরত সাংবাদিদের খুবই সম্মান করতো সে। চায়ের কাপ এগিয়ে বলতো- ভাই, চা খান। আমিও তার আথিতেয়তা পেয়েছি। বার দুই টাকাও দিয়েছি।

নয়াপল্টনে একদিন আলাপের সময় রিজভী জানিয়েছিল তার শারীরিক অসুস্থতার কথা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ সালে, সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে বের করে। শেষদিকে পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এই সময় এসবি’র একটি ওয়্যারলেস সেট হারিয়ে যায় । সেটটি উদ্ধারের জন্য সেখান থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন গ্রেপ্তারকৃতদের একজন এই রিজভী হাওলাদার। গ্রেপ্তারের পর কয়েকদিন ধরে পুলিশ তার উপর অবর্ণনীয় টর্চার করেছে পুলিশ। যা তাকে কেবল শারীরিকভাবেই নয, মানসিকভাবেও দুর্বল করেছিল। দীর্ঘদিন জেল খেটে মুক্তির পর সে হয়ে উঠে দলের প্রতি আরো বেশি নিবেদিতপ্রাণ।

কিন্তু বিএনপি এমন নির্যাতিত কর্মীদের খবর রাখে? পুলিশ কাস্টডিতে এমন টর্চারের দু:সহ অভিজ্ঞতার পরও সাহস হারাননি রিজভী। বিএনপির আন্দোলনের সময় তার সাহসী ভূমিকার কাছে অনেক নেতাও ফেল। এই জিয়া পরিবার অন্ত:প্রাণ নি:স্বার্থ পাগলা রিজভীদের কারণেই টিকে আছে বিএনপি। এই দল পাগল রিজভী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েই ত্যাগ করেছেন শেষ নিঃশ্বাস। পরম করুনাময় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন, জান্নাত নসিব করুন- এই প্রার্থনা।

#নির্বাসিত সিনিয়র সাংবাদিক কাফি কামালের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে

Print Friendly, PDF & Email