এবি পার্টির ইফতারে রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের সম্মেলন
খালেদা জিয়ার মুক্তি
‘ডু অর ডাই’ আন্দোলনে যাবে বিএনপি
বিশেষ প্রতিনিধি |♦|
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি । ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ কী আদেশ দেন, তা দেখেই পরবর্তী কর্মকৌশল ঠিক করতে চান তারা। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, দলের মধ্যম সারি ও তৃণমূল নেতারা খালেদা জিয়ার কারামুক্তির জন্য রাজপথের আন্দোলনে নামতে চাইলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হচ্ছে। তাদের মতে, ক্ষমতাসীনদের ভেতরে নানা বিষয়ে ‘অস্পষ্টতা’ থাকায় বিএনপি এখনই কঠোর কোনও কর্মসূচিতে গেলে তাড়াহুড়োর ফাঁকে ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের’ সুযোগ নিতে পারে স্বার্থান্বেষী মহল।
ফলাফল যাই হোক সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া এখন আর বিকল্প ভাবতে পারছে না বিএনপি । দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে আগামী বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের আদেশের পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আইনিভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দলটি। তবে ‘ব্যর্থ’ হলে রাজপথের কঠোর আন্দোলনের জন্য তৃণমূলকে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের হাইকমান্ড থেকে এ বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক সভায় বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের ভূমিকা নজিরবিহীন। হাসপাতাল আদালতের নির্দেশনা মানল না; অথচ তাদের আবার সময় দেওয়া হলো। অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যখন বলেন খালেদা জিয়া সুস্থ আছেন। তখন চিকিৎসকদের ঘাড়ে ক’টি মাথা আছে যে, খালেদা জিয়া অসুস্থ বলে রিপোর্ট দেবেন। মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে এবং দেশ ও মানুষকে উদ্ধার করতে গোটা জাতিকে আজ ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে নামতে হবে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে জামিনের শুনানি হওয়ার কথা ছিল। আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এতে আদালত আগামী বৃহস্পতিবার পরবর্তী শুনানির তারিখ এবং বুধবার স্বাস্থ্য প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হাসপাতাল খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য প্রতিবেদন জমা না দেওয়া এবং উচ্চ আদালতের আদেশ ক্ষোভ ও হতাশ ব্যক্ত করেছে বিএনপি। খালেদা জিয়া জামিনের ব্যাপারে কিছুটা আশাবাদী হলেও এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে আন্দোলনে সোচ্চার হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় রাজপথের কঠোর কর্মসূচির পরিবর্তে ‘নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচি সীমিত পরিসরে পালন করে আসছেন নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল ও জোটের অপ্রত্যাশিত ফলাফলে হতাশ নেতাকর্মী আবারও রাজপথের কর্মসূচির দাবি তুলতে থাকেন। সেই সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক নেতারাও জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন।
তবে বিএনপির সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা আর সারাদেশে নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সেই দাবিকে গ্রাহ্য না করে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন দলের হাইকমান্ড। একইসঙ্গে নেতাকর্মীদের জামিনসহ মামলা পরিচালনার কৌশল নেওয়া হয়। গঠন করা হয় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। দলকে সব দিকে উপযোগী করতেই এতদিন সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়। এদিকে সরকারের নানা অপকর্মসহ বাজারমূল্য বৃদ্ধির মতো ঘটনায় জনমত তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও অব্যাহত রাখে দলটির হাইকমান্ড। নানা হিসাব-নিকাশ কষে একাদশ সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তি এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আবারও আন্দোলনের ছক কষছেন শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপি সিনিয়র নেতারাও আন্দোলনের চাবিকাঠি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতিনিয়ত দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তাদের উৎসাহিত করছেন। আইনি সহায়তাসহ যে কোনো প্রয়োজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করেছেন। গঠন করেছেন একাধিক সেল। রাজনীতির বাইরে তৃণমূলকে নিয়ে কাজ করছে এসব সেলের দায়িত্বশীলরা। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সেলের মাধ্যমে পেশাজীবী থেকে সর্বসাধারণের সঙ্গে কাজ করারও বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে বিএনপি। যাতে তাদের আন্দোলনকে বিভিন্নমুখী করা যায়। এর মধ্যে শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক ও ব্যবসায়ীসহ সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে ‘বৃহৎ আন্দোলন’ গড়ে তোলার কৌশল নেওয়া হয়েছে। হাইকমান্ডের নির্দেশে এবং নিজেদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় এবার যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে নেতাকর্মীরা জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, খালেদা জিয়াকে সরকার রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার করেছে। এখানে আইনের কোনো বিষয় নয়। এ সরকার থাকলে তিনি মুক্তি পাবেন না। আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। যেসব নেতা এতদিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য চিৎকার করেছিলেন, সেসব নেতাও বলতে শুরু করেছেন আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না। এক বছর ১০ মাস আদালতের রায়ের ওপর ভরসা না করে যদি তারা রাস্তায় আন্দোলন করতেন, তাহলে এতদিনে নেত্রী মুক্তি পেতেন। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে ‘ডু অর ডাই’, ‘মরি আর বাঁচি’ আন্দোলন করতে হবে।
দলীয় সূত্র জানান, আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নেও একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিতদের দিয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়েছে। দেশের মানবাধিকার, অর্থনৈতিক অবস্থা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, লুটপাটসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য-প্রদান করে বহির্বিশ্বকে নিজেদের আস্থায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানান, এবারের আন্দোলন সফল করতে চান তারা। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই তাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এও জানান, বিএনপির নেতাকর্মীদের হারানোর কিছু নেই। মামলা-হামলা আর নির্যাতনের কারণে নেতাকর্মীরা এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর তারা বাড়িঘরে যেতে পারছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি কোথাও তাদের স্থান নেই। যেভাবে মামলার পর মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, তাতে ঘরে বসে থাকলেও নিস্তার পাওয়া যাবে না। তাই তাদের আর হারানোর কিছু নেই।
বিএনপি নেতারা জানান, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে এক লাখ এক হাজার ৯৮৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নামে-বেনামে আসামির সংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৫ জন।