মুখ খুলছে নির্যাতিতরা, বেরিয়ে আসছে ওসি প্রদীপের নিষ্ঠুরতার কাহিনী

দেশনিউজ।

একে একে বেরিয়ে আসছে টেকনাফ থানার সাবেক প্রতাপশালী ওসি প্রদীপ দাশের নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, ক্রসফায়ার ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের লোমহর্ষক ঘটনা। বেরিয়ে আসা একেকটি ঘটনা যেন সিনেমার কাহিনী।

তার ভয়ে যারা এতদিন মুখ খুলতে পারেনি, স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন সেই নির্যাতিত মানুষেরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

এমনি দুইটি ঘটনা ঘটেছিল কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায়। যাদেরকে বাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে দাবিকৃত টাকা না পেয়ে মাদকব্যবসায়ী সাজিয়ে কথিত ক্রস ফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করেছিল।

উখিয়ার বখতিয়ার হত্যা

উখিয়ার বখতিয়ার নামে এক ইউপি সদস্যকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার দেন প্রদীপ। এতে তাকে সহযোগীতা করেন উখিয়ার ওসি মর্জিনা আক্তার।

বখতিয়ার ভাই, একটু বের হবেন? একজন মানুষকে শনাক্ত করতে হবে, আপনি চেনেন কি না। গত ২২ জুলাই গভীর রাতে এভাবেই বাসার বাইরে ডেকে নেয়া হয় কক্সবাজারের কুতুপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিনবারের মেম্বার বখতিয়ার উদ্দিনকে। টেকনাফ ও উখিয়া পুলিশের টিমকে নেতৃত্ব দেন দুই ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও মর্জিনা আক্তার।

রাত ৩টার দিকে বখতিয়ার মেম্বারকে পুলিশের গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন দেনদরবার করেও জানা যায়নি কোথায় আছেন তিনি। বিকেলে খবর আসে টেকনাফ থানায় রাখা হয়েছে তাকে।

২৩ জুলাই রাত ৮টার ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে পুলিশ ফিরে আসে ঐ বাসায়। গাড়িতে রাখা হয় বখতিয়ারকে। বাসা থেকে নেয়া হয় নগদ ৫১ লাখ টাকা, ১০ ভরি স্বর্নালংকার, জমির দলিল, চেকবইসহ মূল্যবান নানা কাগজপত্র। এ সময় ঐ পরিবারের নারী সদস্যদেরও লাঞ্ছিত করেন পুলিশ সদস্যরা।

২৪ জুলাই ভোরে জানা যায়, পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন দুজন। একজন বখতিয়ার মেম্বার, আরেকজন মো. তাহের।

দুজনই মাদক ব্যবসায়ী এমন দাবি করে টেকনাফ খানা পুলিশ জানায়, হ্নীলার ওয়াংব্রা থেকে ইউনুস নামে একজনকে ২০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পরম সে জানায় তাহেরের নাম। তাহের দেয় বখতিয়ারের তথ্য। তারপর বখতিয়ারকে নগদ ১০ লাখ টাকা ও ২০ হাজার ইয়াবাসহ আটকের পর ভোরে আটককৃতদের নিয়ে আরো ইয়াবা উদ্ধারে গেলে গুলি চালায় তাদের সহযোগীরা। দুপক্ষের গোলাগুলিতে মারা যান দুজন, আহত হয় তিন পুলিশ সদস্য।

ঘটনাস্থল থেকে ৫টি দেশীয় অস্ত্র, ১৭ রাউন্ড গুলি ও ১৩ টি গুলির খোসা উদ্ধারের দাবি করে পুলিশ। কিন্তু বখতিয়ারের বাসা থেকে নেয়া টাকা ও স্বর্নালংকারের কোন খবর নেই। জানা যায়, ঐ টাকার ৩৩ লাখ নিয়েছেন ওসি মর্জিনা আর বাকি ১৮ লাখ নেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

টেকনাফের জলির হত্যা

টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড পশ্চিম মহেশখালীয়া পাড়ার মৃত আলী আহাম্মদের পুত্র সিএনজি চালক আব্দুল জলিলের প্রকাশ (গুরা পুতুইক্কা)।

সূত্রমতে, সিএনজি চালক জলিলের রয়েছে দুই শিশু সন্তান ও স্ত্রীসহ ভাইবোন আত্মীয়-স্বজন। গাড়ি চালিয়ে যে কোনো মতেই সংসার চালাত জলিল। কিন্তু বেশি দিন তার কপালে সয়নি সন্তান, স্ত্রী ও ভাই, বোনসহ আত্মীয়স্বজনের ভালবাসা।

আবদুল জলিলের স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম (২৬)গণমাধ্যমকে জানান, গত বছরের ২ ডিসেম্বর সিএনজি চালক স্বামী বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে মেডিকেল দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। পরদিন ৩ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় কক্সবাজার পৌঁছে ব্যক্তিগত কাজে কক্সবাজারের আদালত পাড়ার মসজিদ মার্কেটে যায়। ওই সময় ডিবি পুলিশের এক ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে সাদা পোশাকদারী কয়েকজন স্বামী জলিলকে আটক করে নিয়ে যায়।

পরে এই খবর শুনার পর স্বামীর সন্ধান পাওয়ার জন্য কক্সবাজার-টেকনাফের সংশ্লিষ্ট আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন দফতরের দরজায় কড়া নাড়েন তিনি। কিন্তু কোথাও স্বামীর খোঁজ মেলেনি। খেয়ে না খেয়ে স্বামীর খোঁজে পার করে কয়েক মাস। পরে কক্সবাজারের স্থানীয় সংবাদিকদের মাধ্যমে “আমার স্বামী দুই মাস ধরে নিখোঁজ” শিরোনামে পত্রিকায় সংবাদ প্রচার করে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।

কিন্তু একদিন প্রদীপের টর্চার সেল থেকে জেলহাজতে যান হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহেদ। আর জাহেদ থেকে খবর পায় জলিল টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপের টর্চার সেলে রয়েছে। তাকে ডিবি ধরার পর হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির আইসি মশিউরের মাধ্যমে টেকনাফ থানায় হস্থান্তর করা হয়।

তারপর থেকে বেশ কয়েকবার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ছেনুয়ারা। অঝরে কান্নাকাটি করে পৌঁছায় ওসি প্রদীপের দরজায়। কিন্তু প্রদীপের দাবি বিশাল। ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। না হয় স্বামী ক্রসফায়াওে যাবে। পরে হাতে পায়ে ধরে বিদেশ যাওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা ৫ লাখ টাকা দেন ছেনুয়ারা। তাতে কোন কাজ হয়নি। শত চেষ্টায় দেখাও করতে পারেনি স্বামীর সঙ্গে। তবে জীবনের শেষ পর্যায়ে দেখা হয় স্বামী জলিলের সঙ্গে। কিন্তু কথা হয়নি। কারণ তখন স্বামী জলিলের রক্তাক্ত শরীর নিয়ে নিতর দেহে পড়ে ছিল হাসপাতালের মর্গে।

নিহত জলিলের বড় ভাই আব্দুর রশিদ বলেন, দীর্ঘ পাঁচ মাস আগে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য থানায় যাই। তবে দেখা করতে পারেনি। ওসি প্রদীপ নিজেই তাকে বলেছে তোমার ভাই বড় মাদক ব্যবসায়ী। তাকে যদি বাঁচাতে চাও ৩০ লাখ টাকা নিয়ে আসো। তখন ওসি প্রদীপকে আমি (রশিদ) বলি এত টাকা আমরা কোথায় পাবো স্যার। আমরা গরিব মানুষ, আমার ভাই কোনদিন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালায়। এভাবে থানার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় দীর্ঘ আট মাস। কিন্তু ভাইকে দেখার সুযোগ দেয়নি প্রদীপ।

একপর্যায়ে গত মাসের ৭ জুলাই গভীর রাতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হোয়াইক্যং খারাংখালী সীমান্তে আমার বাড়ির পাশে ভাই নিহত হয়েছে। পরে খবর পেয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি আমার ভাই জলিলকে চেনার কোন উপায় নেই। ৩৪ বছরের যুবক জলিল দাড়ি, গোঁফ, চুল ও শরীরের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল ৯০ বছরের বৃদ্ধ।

আবদুর রশিদ আরো বলেন, ওই সময় মহান আল্লাহর কাছে ওসি প্রদীপের বিচার চেয়েছিলাম। সর্বশেষ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ দেখাচ্ছে।

এ বিষয়ে উখিয়া-টেকনাফের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আদিবুল ইসলাম বলেন, গত জুলাই মাসের শুরুতে আমি অতিরিক্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করি দুই থানার। তবে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার সময় আমি করোনায় আক্রান্ত ছিলাম। যে কারনে এই বিষয় সর্ম্পকে আমি অবগত নই।

ডিএন/সিএন/জেএএ/১১:৫পিএম/৮৮২০২০২৭

Print Friendly, PDF & Email