এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আল্লামা শাহ আহমদ শফী

নিজস্ব প্রতিবেদক |

অসাধারণ দায়িত্ববোধ, গভীর জীবন দর্শন ও নিরলস শ্রমের এক অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব আল্লামা শাহ আহমদ শফী। ইসলামি মহা জগরণের মহানায়ক তিনি। কোটি ভক্ত, অনুরাগী ও শিষ্যকে কাঁদিয়ে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে নাস্তিক-মুরতাদদের আকস্মিক উত্থান এবং আল্লাহ, রাসূল, আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি একশ্রেণির ব্লগারের সীমাহীন বিষোদগারের ফলে সৃষ্ট আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা বয়োবৃদ্ধ এক নেতার নাম আহমদ শফি । তিনি জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এটাই তাঁর দায়িত্ববোধ, গভীর জীবন দর্শন ও উম্মাহর প্রতি দায়বদ্ধতা।

অশীতিপর তিনি- এ কথা মনে হয়নি কখনও তার নেতৃত্ব দেখে। ইসলাম অবমাননার প্রতিবাদে বয়সের তোয়াক্কা করেননি তিনি। বরং নতুন উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করেছেন। সর্বস্তরের আলেম ও ধর্মপ্রাণ জনগণ তার ডাকে ২০১৩-এর নাস্তিক মুরতাদবিরোধী আন্দোলনে সংগঠিত হন। দেশের আলেমসমাজ নানা কারণে আল্লামা শফীর প্রতি আস্থা রাখেন। তিনি গতানুগতিক কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন, তাই তাকে বিশ্বাস করেছে সবাই। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই সফলভাবে গড়ে তুলেন তিনি হেফাজত আন্দোলন।

ধারণা ও প্রথাগত ঐতিহ্য নেতৃত্ব থাকবে ঢাকায়, এই অচলায়তন তিনি ভেঙেছেন। শেকড় থেকে ওঠে আসা তার সাহসী নেতৃত্ব, তার স্মিত হাসি ভরসা জুগিয়েছে আপামর জনগণকে। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন, তিনি শায়খুল আরব ওয়াল আজম হোসাইন আহমদ মাদানি রহমাতুল্লাহি আলাইহির খলিফা, তিনি উম্মুল মাদারিসখ্যাত হাটহাজারি মাদরাসার মুহতামিম, তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সভাপতি, তিনি একজন নবতিপর বুজুর্গ ব্যক্তি, তিনি একজন শায়খুল হাদিস। তাই তাঁর ডাকে সংগঠিত শতাব্দীর অন্যতম গণজাগরণ হেফাজতে ইসলাম শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। এ এক বিস্ময়।

আল্লামা আহমদ শফী ১৯৩০ সালের ৫ এপ্রিল (পাসপোর্টের হিসাবমতে) বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পাখিয়ারটিলা নামক গ্রামের এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী দীনদার আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. বরকত আলী, মাতা মেহেরুন্নেছা বেগম।

আল্লামা শফীর নিয়মিত শিক্ষাজীবন শেষ হয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে। এখান থেকেই তিনি মাওলানা সনদ লাভ করেন। দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় আহমদ শফী শায়খুল ইসলাম হজরত হোসাইন আহমদ মাদানির হাতে বায়াত গ্রহণ করেন এবং অতি অল্প সময়ে খিলাফতপ্রাপ্ত হন। তিনি উপমহাদেশে খ্যাতিমান ইসলামি আইন বিশারদ মুফতি ফয়জুল্লাহ, শায়খুল হাদিস আল্লামা সুফি আবদুল কাইউম, শায়খুল আদিব আল্লামা মুহাম্মদ আলী নিজামপুরী ও শায়খ আল্লামা আবুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, প্রখর মেধাবী ও সুবুদ্ধির অধিকারী হওয়ায় আল্লামা শফী তাঁর উস্তাদদের বিশেষ নজরে থেকে শিক্ষা জীবন কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করেন।

আল্লামা শফীর কর্মজীবন শুরু হয় হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৪০৭ হিজরিতে তিনি এ মাদরাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। এখনও তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন করেছেন। সর্বশেষ ছাত্র বিক্ষোভের মুখে একদিন আগে স্বেচ্ছায় মহাপরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন তিনি। শুরা তাকে উপদেষ্টা বা সদরে মুহতামিম হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি নিজের মেধা, শ্রম, কর্মচিন্তা আর সৃষ্টিশীল সুকুমারবৃত্তির চর্চায় নিজেকে তৈরি করেছেন লাখে একজন হিসেবে।

পীরে কামেল, শায়খুল হাদিস, লেখক, খতিব, ওয়ায়েজ, মাদরাসার পরিচালক, সংগঠনের আমির, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক বহু অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায় তাঁকে । তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাদা মনের বিশাল হৃদয়ের এক মহানুভব ব্যক্তিত্ব। যার শিশুসুলভ সরল হাসি যে কারও মন জয় করে নিতে পারে।

তাঁর নেতৃত্বে সূচনা হয় এক ইতিহাসের। দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে এ সংক্রান্ত বিল পাস হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসারে পরিচালিত হবে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি আইনে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আলেমরা আল্লামা শফীর নেতৃত্বে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি কারণে একতাবদ্ধ হন। আলাদা আলাদা বোর্ডগুলো একটা সংস্থার অধীনে আসে। এটা বিরল অর্জন।

ব্যক্তিজীবনে আল্লামা শফী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াননি। তবে ইসলাম ও মুসলমানদের যেকোনো সংকটে আল্লামা শাহ শফীর আহ্বানে পারস্পরিক মতভেদ ভুলে সবাই ছুটে যান তাঁর কাছে। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রয়োজনে সাড়া দিতে কখনও দেরি করেন না তিনি। এ কারণে বহুধাবিভক্ত ইসলামি নেতৃবৃন্দের ঐক্যের প্রতীক বলা হয় আল্লামা শফীকে।

আমল ও সংশোধনীমূলক বক্তব্যই বেশি দিয়েছেন তিনি। দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কঠিন কথাগুলোও তিনি সহজ-সরলভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে জ্বালাময়ী বক্তব্য তিনি দেননি কখনও।

বিশ্বের আনাচে-কানাচে আল্লামা আহমদ শফীর ছাত্র, শিষ্য, মুরিদ, ভক্ত ও অনুসারী রয়েছে। এ সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। আল্লামা শফীর নম্রতা, সুন্নতের অনুসরণ, খোদাভীরুতা, ইলম ও প্রজ্ঞা তাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। দেশবাসী তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ বলে সম্বোধন করেন। কেউ বলেন হাটহাজারীর হজরত। এসবই তার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ।

২০০১ সালে পবিত্র উমরা পালনের জন্য সৌদি আরব গেলে হারামাইন শরিফাইনের মহাপরিচালক শায়খ সালেহ বিন আল হুমাইদ তাঁকে পবিত্র কাবার গিলাফের একটি অংশ হাদিয়া প্রদান করে সম্মানিত করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় সিরাত কমিটি, তমদ্দুন মজলিসসহ বেশকিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন আল্লামা আহমদ শফীকে শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছেন। এগুলো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অন্যতম স্বীকৃতি।

দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিল, শানে রিসালাত সম্মেলনসহ নানা সভা-সেমিনারে যোগ দিয়েছেন। এসব সভায় তিনি ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি নাগরিককে দীনি ইলম শিক্ষার পাশাপাশি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। গোনাহমুক্ত জীবন-যাপনের কথা বলেছেন।

লেখালেখিতেও রয়েছে তাঁর রয়েছে বিশেষ অবদান। বাংলা ও উর্দু ভাষায় তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। এ ছাড়া উর্দু ও বাংলা ভাষায় তাঁর আরও অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। এই বয়সেও তার এমন কর্মতৎপরতা সত্যিই ঈর্ষণীয়।

২০১৭ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত যান তিনি। দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ সফরে যান। ওই সফরে আল্লামা আরশাদ মাদানিসহ দেওবন্দের আলেমরা তাঁকে বিপুল অভ্যর্থনা জানান। বাংলাদেশি আলেমদের জন্য এ এক বিশাল প্রাপ্তি।

এর আগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সভাপতি ও দারুল উলূম দেওবন্দের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা সৈয়দ আরশাদ মাদানি হাটহাজারী পরিদর্শন করেন। এ সময় সৈয়্যদ আরশাদ মাদানি ও আল্লামা শাহ আহমদ শফী সালাম-মুসাফাহা শেষে পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং কুশল বিনিময় করেন। দুই বুজুর্গের এমন ভালোবাসা বিনিময়ের বিরল দৃশ্য ইতিহাস হয়ে আছে।

দেশ-বিদেশে আল্লামা শফী প্রচুর খলিফা রয়েছেন। তন্মধ্যে শুধু ঢাকাতে রয়েছেন শতাধিক খলিফা। যারা বিভিন্ন দীনি খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে আল্লামা আহমদ শফী বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত বিবৃতি ও দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে দেশ ও জাতি ও সরকারকে সতর্ক করে আসছেন। বিশেষ করে করোনার কারণে মসজিদে জামাত চালু, কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা বিষয়ে তার বিবৃতি জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছে।

আল্লামা শফী পাঁচ সন্তানের জনক। তন্মধ্যে দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ, ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানি। মেয়ের জামাতাদের তিনজনই আলেম। আল্লামা শফীর স্ত্রীর নাম ফিরোজা বেগম।

এর আগেও কয়েক দফা অসুস্থ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এবং হজমজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বার্ধক্যের কারণে এসব রোগ মাঝেমধ্যেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় তার মৃত্যুর খবরও ছড়িয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email