‘আমি দোষী, আমি শাস্তি পাওয়ায় যোগ্য’

নিউজ ডেস্ক | সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। আর সে অভিজ্ঞতা লিখেছেন তার ফেসবুক টাইমলাইনে। তাঁর এ অভিজ্ঞতা খোদ রাজধানীতে। Rezaul Islam নামক ফেসবুক আইডিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের ‘আমি দোষী, আমি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য’ শিরোনামে লেখাটি দেশ নিউজ এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো। লেখাটিতে বানানজনিত কিছু সমস্যা আছে তা পাঠকরা ইগনোর করবেন বলে আশা করা যায় ।
…….……………………………………………..
ভাবছিলাম বিষয়টি কাউকে জানাবো না। কিন্তু শেষমেষ আর পারলাম না। গত রোববার ১০ নভেম্বর ছিলো সরকারি ছুটির দিন। সেদিন বাংলাদেশ ভারত টি-২০ এর ফাইনাল খেলা ছিল। ছুটির দিন, একটু খাওয়া দাওয়া অন্য রকম ছিলো। আমি বাইরের কোন জিনিস খাই না, খুব হিসেব করে খাই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে চাকরি করার সুবাদে ও বাজার মনিটরিং করার কারনে এই বিষয়টা আমার ভিতর প্রচন্ডরকম কাজ করে। খাবার হোটেল গুলোর আনাচে কানাচে আমি ঘুরেছি। লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছি। এর চেয়ে বেশী আজ আর বলতে চাচ্ছি না।
ছুটির দিন। ঘিয়ে ভাজা পরেটা, ঝাল মাংস, সুজি, দেশি কৈ মাছ ফুলকপি দিয়ে রান্না,ইলিশ মাছ ( গাদা, পেটি, ডিম, মাথা), দুধের চা, কফি, বিকেলে ছোলা ভুনা, মুড়ি,বকফি। রাতে আবার খাবারের মেনুতে সব’শেষ ছিল খাটি দেশী গরুর দুধ (বড় পুরু সর সহ) সব খেয়েছি। খেলা দেখছি, হেরে যাওয়ার যন্ত্রণাও আছে।

আগেই বলেছি আমি দোষী। নইলে এভাবে খেতে যাব কেন?? খেয়ে যেহেতু ফেলেছিই!!!!!!
রাত১১.৩০ এর দিকে পেটে প্রচন্ড রকম ব্যাথা আর এসিড ফম’। কিযে যন্ত্রণা! টিকতে না পেরে আমাদের রাজবাড়ীরই কৃতিসন্তান সহিদ ভাইকে ফোন দিলাম।উনি প্যারামেডিক, নিজের ডিস্পেন্সেরী আছে। বললাম শীঘ্রি আসেন, আমার অবস্থা ভালো না।আমার ছটফটানি দেখে আমার তিনটি মেয়ে আর আমার স্ত্রী এলিজা খুব কান্নাকাটি করছিলো। আমি ধৈয্য’ ধরে সাহসিকাতার সাথে সব মোকাবেলা করছিলাম। আমি সহিদ ভাইকে বললাম ইঞ্জেকশন নিয়ে আসেন। এর মধ্যেই আমার অনেক কাছের একজনমানুষ ডাক্তার নাজমুল, যিনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, এফসিপিএস। আমার গা টাও ঘামছিলো।সব কথা ডাঃ নাজমুল কে বলার পর উনি তাড়াতাড়ি ন্যাশনাল হাট’ ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গিয়ে ইসিজি করতে বললেন। রাত তখন ১২.৩০ এর মত।আমি বললাম আমার হাটে’রকোন সমস্যা নাই। গত প্রায় ১০ বছর যাবত প্রেসার নরমাল। ডায়াবেটিসও নাই।খুব হাসিখুশি মানুষ আমি। তারপরও উনি বারবার যাওয়ায় জন্য বলছিলেন। সহিদ ভাই আমার সাথে ছিলেন, আমার শ্যালক রুবেল আর ওর ওয়াইফ অনন্যাও আসলো, আমার ওয়াইফ তো ছিলেনই। ড্রাইভারকে আসতে বললাম। কিন্তু অতসময় দেরি না করে উবারে করে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গেলাম জরুরি বিভাগে। ওরা আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ইসিজি করলো, প্রেসার মাফলো। সবই নরমাল। প্রেসার গতানুগতিক এর চেয়ে( ১২০/৮০) একটু বেশী পেল। আমি তখন পেটের ব্যাথায় কাতরাচ্ছি। ওরা বললো এখানেতো হাটে’র চিকিৎসা হয়। এখানে আপনার চিকিৎসা নাই।তখন সহিদ ভাই বললেন আমার কাছে ইঞ্জেকশন আছে, এটা দিয়ে দেখেন। ওরা সহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে ইঞ্জেকশন নিয়ে আমার ভেইনে পুশ করলো। এবং শহীদ সোহরাওয়াদী’ হাসপাতালে রেফার্ড করলো।আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী এলিজা, রুবেল,ওর ওয়াইফ এবং সহিদ ভাই। মিনিটে মিনিটে আমার তিনটা মেয়ে ওদের মাকে ফোন দিচ্ছিল। আব্বু কি ভাল আছে? আমরা হাসপাতালে চলে আসবো ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার ড্রাইভার তখনও না আসাতে আবারও উবার নিলাম। আমি ছটফট করছি। উবারের ড্রাইভার আপ্রান চেস্টা করছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে।রাত তখন ১টার উপরে বাজে। আমার এই চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত নিরাপদ স্থান শহীদ সোহরাওয়াদী’ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসলাম। দেখলাম ৫/৭ জন কম বয়েসী ডাক্তার। একজন মহিলা ডাক্তার, ৩৫/৪০ বছর বয়েস হবে। তারা বসে চিপস খাচ্ছে, কেউ মোবাইলে ফেসবুক চালাচ্ছে। ঘটনা শুনার পর মহিলা ডাক্তার বললেন একটা এন্টাসিড ট্যাবলেট খেতে। আমি তখন আরও দুব’ল হয়ে পরেছি।এন্টাসিডের চেয়েও ৩/৪ জেনারেশন পরের ওষুধ খেয়েছি। এন্টাসিড ট্যাবলেট দেয় কিভাবে? আমি বললাম প্লিজ আমার জরুরী চিকিৎসা দেন ম্যাডাম। আমি কিন্তু আর সহ্য করতে পারছি না।দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।সেরকম আমলেই নিল না ডাক্তার সাহেবরা। অগত্যা মেডিসিন এর ডাক্তাররা বসেন যেখানে সেখানে পাঠালেন। আমি কোন জায়গায় আমার পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি না।তাও সহিদ ভাই বললেন উনি অর্থ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব। মেডিসিনের একজন কমবয়সী ডাক্তার বসে দেখে উনার কাছে গেলাম।উনি কাগজ পত্র দেখে ১ নং ওয়াড’ এ যেতে বললেন। ওখানে কোন ডাক্তার নাই। দেখলাম একজন নাস’ বসে আছে। আমার পরিচয় দিয়ে বললেও কোন কন’পাত করলেন না।বললেন সিট খালি নাই। আমি বললাম প্লিজ আমাকে জরুরী চিকিৎসা দেন। আমাকে ফ্লোরে রাখেন।আমি কিন্তু মারা যাচ্ছি। নাস’ বললেন কিছু করার নাই।আমার ওয়াইফ কান্নাকাটি করছিলো। ইতোমদ্ধে রাত ২ টা বেজে গেছে। উপরের রুমে দেখেন, নাস’বললেন। উপরে গিয়েও কোন সুরাহা হলো না। আমি এরুম ওরুম এতালা ওতালা করে কোন একটা ফ্লোরে বেঞ্চে বসে পেট ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। আমার সাথে সবাই এরুম ওরুম ছুটাছুটি করছিলো। মেডিসিনের সেই ডাক্তারের কাছে আবার গেলে উনি বললেন আমিতো লিখে দিয়েছি,আমার আর দায়িত্ব নাই।আবার আসলাম সেই ইমারজেন্সি রুমে। ডাক্তাররা চিপস খাচ্ছিল এবার দেখলাম সাথে কিছু ফল ফলাদিও আছে।মোবাইল টিপাটিপি ত আছেই। আমি আবার মহিলা ডাক্তারকে বললাম ম্যাডাম আমার চিকিৎসা দেন। আমি সহ্য করতে পারছি না। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। আমি জানি আমি মরে গেলে ওই ডাক্তারদের কিচ্ছু হবে না। আমার তিনটি মেয়ে এতিম হবে,আমার ওয়াইফ বিধবা হবে।আমি যখন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন কত মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম এইসব হাসপাতালে।ওদের অবহেলা আর অবজ্ঞার ভাব দেখে কোন চিকিৎসা না নিয়ে ঘন্টা দুয়েক সময় নস্ট করে চলে আসলাম এই হাসপাতালেরই রাস্তার অপর পারে কেয়ার হাসপাতালে। ইমারজেন্সিতে ছিলেন ডাঃ নাসির। যাওয়ার সংগে সংগে উনি আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ইঞ্জেকশন পুশ সহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা শুরু করলেন বড়জোর ২/৩ মিনিটের ভিতরে। কি যে তার চেস্টা এবং আমাকে শান্তনা দেয়া।আমি আছি স্যার, কোন চিন্তা করবেন না। তিনি জরুরী ভাবে আমাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করলেন।ভোর ৪/৫ টার দিকে বাসায় ফিরলাম।

ইতোমদ্ধেই আমি খুলনা যশোর এলাকায় সরকারি প্রগ্রাম দিয়েছিলাম। সামান্য সুস্থ হয়েই আমি খুলনা চলে এসেছি। ডাঃ নাজমুল, ডাঃ নাসির কম করে হলেও ১০/১৫ বার করে ফোন দিয়েছে।স্যার কেমন আছেন? সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। ডাঃ নাসিরের ভিতর একটা আনন্দের অনুভূতি লক্ষ্য করলাম আমাকে সুস্থ করার পর। ইনারাও তো ডাক্তার। দায়িত্ববোধ থাকবে না কেন? সোহরাওয়াদী’ হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবরা এরুপ কান্ডগ্যানহীন আচরণ করলেন কেন? ঢাকার প্রানকেন্দ্রের একটি হাসপাতাল!! পাশেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। আমি সব ডাক্তার সাহেবদের কথা বলছি না।প্রায়ই দায়িত্বশীল। কিন্তু কিছু কিছু বাজে ডাক্তারদের দায়িত্ব পুরো ডাক্তার সমাজ নিতে যাবে কেন?ওরা ঢাকা শহরেই পোস্টিং নিয়ে থাকবে কেন? আমি এই হাসপাতালের পরিচালক সাহেবকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছি, ফোন ধরেননি।হয়তো ব্যস্ত আছেন। আমি সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব, এটা বাদ দিলাম,আমি পরিচয়ও দেই না কোন কাজে।কিন্তু একজন সাধারন রোগী হিসাবে ত আমার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার ছিল। ওই রাতে আমার কোন শুভাকাঙ্ক্ষীকে জানাইনি। তাহলে আমার বিশ্বাস আমলা,সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত,রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত,শুভাকাঙ্ক্ষীরা এসে হাজির হতো। এটা আমি অর্জন করেছি।আমি খুলনায় সরকারি সফরে , আজ বিকেলে ঢাকায় ফিরবো।কান্ডগ্যানহীন এসব ডাক্তারদের জন্য সরকারের বদনাম হচ্ছে। আমি নিজেই এদের শিকার।অনেক ডাক্তারদের সুনাম আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আমরা চাই না এসব দায়িত্বহীন ডাক্তারদের।দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এমন ব্যবহারের কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।

Print Friendly, PDF & Email