এক মঞ্চে জামায়াতকে তুলতে আপত্তি গণতন্ত্র মঞ্চ ও বাম ঐক্যের
আতাউর রহমান ।।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। নির্বাচনে দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিতে না যাওয়ায় তাদের আন্দোলনে বিজয় হয়েছে বলে দলগুলোর মূল্যায়ন। এখন চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চায় তারা। সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আগামীর আন্দোলনসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসকে একমঞ্চে সমবেত করার পক্ষে যুগপতের মিত্ররা। এ দীর্ঘমেয়াদি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠনের জন্য বিএনপির কাছে প্রস্তাবও দিয়েছে দুটি জোট।
চলমান আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতি দিতে বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের আদলে জামায়াতসহ সরকারবিরোধী সব দল নিয়ে একমঞ্চ গঠনের পক্ষে তারা। যদিও জামায়াতকে যুক্ত করার প্রশ্নে দুটি জোটের আপত্তির কারণে নির্বাচনের আগে এমন উদ্যোগ সফল হয়নি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের অধিকাংশ শরিকের অভিযোগ, নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। বিশেষ করে অসহযোগ আন্দোলন, ভোটের দিন ঘিরে হরতাল এবং ভোটের পরে গণসংযোগের কর্মসূচি এককভাবে দেওয়া হয়েছে। এতে যুগপতের মিত্রদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে। আন্দোলন ঘিরে দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা।
মিত্ররা মনে করছে, আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হলে বিএনপিকে এ ধরনের মনোভাব পরিহার করতে হবে। কারণ, সবার মতামতের ভিত্তিতে কর্মসূচি প্রণয়ন করলে আন্দোলন ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এদিকে সরকারি ভয়ভীতি, প্রলোভন সত্ত্বেও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কোনো দল নির্বাচনে যায়নি। অন্যদিকে, এবারের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ভালো আচরণ করেনি। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর নেতাদের চাওয়া, বড় দল হিসেবে বিএনপি যেন ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে একই আচরণ না করে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের পর সার্বিক করণীয় নির্ধারণে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল ও জোটের মতামত নিতে শুরু করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এবং গতকাল বুধবার গণঅধিকার পরিষদ (দুই অংশ), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) এবং গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আলাদাভাবে বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। আগামী শনিবার গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে দলটি। এরপর সবার মতামত, প্রস্তাবনা সমন্বয় করে করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি। তারপর নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে দলটি।
বিএনপির দাবি, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলা হলেও ৭ জানুয়ারি ৫-১০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। তাই ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার দেশব্যাপী দুদিন জনগণের মাঝে শুভেচ্ছা সংবলিত লিফলেট বিতরণ করেছে বিএনপি। বিএনপি ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে দশ দফার ভিত্তিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। এরপর গত ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনে ৪০টির মতো দল সম্পৃক্ত হয়। এ ছাড়া একই দাবিতে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন বর্জন করে যার যার অবস্থানে থেকে আন্দোলন করে যুগপতের বাইরের বাম গণতান্ত্রিক জোট, ধর্মভিত্তিক পাঁচ দলের মোর্চা ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’ এবং চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তবে ৭ জানুয়ারির ভোট ঘিরে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে সাংগঠনিক শক্তি বিবেচনায় দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতকে শক্তভাবে পাশে চেয়েছিল বিএনপি। এর অংশ হিসেবে যুগপৎ এবং যুগপতের বাইরে আন্দোলনরত সব দলকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কিন্তু যুগপতের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ এবং গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত এক প্ল্যাটফর্ম হয়নি। যদিও আন্দোলনের স্বার্থে জামায়াতকে যুগপতে সম্পৃক্ত করার বিরোধী ছিল না গণতন্ত্র মঞ্চ। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ও যুগপৎ আন্দোলন উভয় ক্ষেত্রে চরম আপত্তি ছিল চার দলের মোর্চা গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের। জামায়াতকে নিয়ে দুটি জোটই এখনো আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপতের অন্য শরিকদের অভিমত, আগামীতেও কর্মসূচি সফল করতে হলে জামায়াতে ইসলামীকে আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ, আন্দোলনে সাংগঠনিক দিক থেকে বিএনপির পরেই জামায়াতের অবস্থান। আর মাঠের আন্দোলন সফল করতে হলে সাংগঠনিক শক্তি দরকার, যেটা জামায়াতের রয়েছে। যুগপতের অন্য শরিকরা মাঠে থাকলেও সাংগঠনিকভাবে তারা অতটা শক্তিশালী নয়। তাই আন্দোলনে জামায়াতকে সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই।
জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে দাবি আদায়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলে অভিমত দেয় ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। ভবিষ্যতের সেই আন্দোলন সফলে জামায়াতসহ ডান-বাম সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রস্তাব দেয় জোট দুটি। তবে বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাবের ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। বৈঠকে সরকারের নানামুখী চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও ভোটে না যাওয়া এবং জোট ও আন্দোলন থেকে সরে না যাওয়ায় বিএনপির পক্ষ থেকে জোট নেতাদের ধন্যবাদ জানানো হয়। একই সঙ্গে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও জনগণের বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়। শরিকদের আশ্বস্ত করা হয়, আন্দোলন অব্যাহত রাখলে বিজয় সুনিশ্চিত। এরপর সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। আন্দোলনে থাকা শরিকদের যোগ্যতা বিবেচনায় সেই সরকার এবং অন্যভাবে যথাযথ মূল্যায়ন করবে বিএনপি।