বিএনপির পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ও রাজনীতির সদর-অন্দর

▪️ মাহমুদ হাসান ▪️

খেলা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। রাজপথের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন শুধু নয়, সর্বপরি এ সরকারের অধীনেই কোন নির্বাচনে অংশ নিবে না তারা। যদিও দলটির ভিতরে কিছু লোক নানা সমীকরণ দিয়ে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এ থেকে দলকে সরিয়ে আনতে। তবে এবার এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সফলতা নিয়ে জনমনে যেমন সন্দেহ রয়েছে একই সাথে সচেতন মহলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও আছে তাদের ওপর। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে দলটি আবারো খাদের কিনারায় পৌঁছে যাবে এ সন্দেহে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আছে ভ্যান গার্ডের ভূমিকায়। দলের এই সুবিধাভোগীরা এ কাজ অতীতেও বেশ কয়েকবার করেছেন। এবারো সে চেষ্টায় আছেন তারা।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ‘ অবস্থান ঘোষণার পর রাজনীতির অন্দরমহলে যেমন শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ তেমনি মাঠের রাজনীতিতেও দৃশ্যমান হচ্ছে নানা ঘটনা। কেউ কেউ এটাকে নাটক হিসেবেও দেখছেন। বিএনপির এই ঘোষণার পর ২০ দলীয় জোট ও মহাজোট উভয় জায়গাতেই কিছু লোক নেমেছে বিকল্প মিশন নিয়ে। আর মূল লক্ষ্য হলো নিজেরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে হালুয়া রুটির ভাগ নেয়া ও নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া। তাদের মাঝে অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল অলি আহমদ বলেছেন জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলনে নামবেন। একদিন আগেই জামায়াত নেতাদের পাশে বসিয়ে এমন বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। আর মহাজোটের বড় অংশীদার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন- তারা আর মহাজোটে নেই। একই সাথে ইভিএমকে কারচুপির মেশিন হিসবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি।

অনেকেরই মনে থাকার কথা বীর মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমেদ ২০-দলীয় জোটের শরিক একটি দলের এ্যাসাইন্টমেন্ট নিয়ে বিএনপিকে সরিয়ে জোটের প্রধান নেতা হতে চেয়েছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন তরান্বিত করার দাবী নিয়ে। তাঁর ধারণা ছিল এতে বিএনপির তৃণমূলের সমর্থন পাবেন তিনি। কিন্তু তার এ দুরভিসন্ধি পরে আর এগোয়নি। যে জামায়াত বিএনপি জোট ছাড়ার পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছে তাদের নিয়েই তিনি বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলন করবেন। আসলে পর্দার আড়ালের বুঝাপড়া এরকম। সহযোগী হিসেবে আন্দোলনের মাঠ গরম করে এক সময় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা। তার আগে সরকারের সাথে দেন-দরবার করে সীট ভাগাভাগি ও রাজনৈতিক দল হিসেবে নতুন নিবন্ধন নেয়া।দরকষাকষির নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামায়াতকে সাথে নিয়ে এলডিপি সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান পাকাপোক্ত করা ও বিরোধী দলের নেতার আসনে বসার খায়েশ পূরণ করাই থাকবে মূল লক্ষ্য।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও এরশাদের ভাই জি এম কাদের আজই বললেন তারা মহাজোটে নেই। অর্থাৎ সরকারের সাথে প্রকাশ্যে দেন-দরবারের রাস্তা খুললেন। দৈনিক সমকাল পত্রিকায় সম্প্রতি ‘সরকার পশ্চিমা চাপে আছে’ এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে। এই চাপটা মূলতঃ রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি’র অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে তা সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রমানিত হবে না বলেই পশ্চিমারা মনে করে। তবে পশ্চিমাদের এ ইচ্ছের প্রতিফলন বিএনপি কতটা দিতে পারবে তা সময়ে বুঝা যাবে। যাক এটা অন্য প্রসঙ্গ। জাতীয় পার্টির ভূমিকা হঠাৎই ইউটার্ন কেন তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ আছে। এরশাদের হাতে গড়া এ দলে দিন দিন সরকারের পক্ষে থাকার নেতা-কর্মীর সংখ্যা কমে আসছে। পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন চাচ্ছে না সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে রাজনীতি করতে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চান জি এম কাদের গংরা। তাদের চিন্তা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে গণতন্ত্রকামী জনতার কাতারে এসে জনসমর্থন বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের সাথে সর্বোচ্চ দরকষাকষি করা। তাতে অন্তত পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দলের অবস্থান নিশ্চিত করার সুযোগ থাকবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই দু’টো সমীকরণই হলো রাজপথে নেতৃত্বদানকারী প্রধান দল বিএনপিকে কৌশলে নির্বাচনের বাইরে রাখা। এ সব করার পিছনে কলকাঠি তো মূল জায়গা থেকেই করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি আগে বা যথাসময়ে নির্বাচন করতেই হয় তাহলে বিএনপি অংশ না নিলেও এ কয়টা দলকে অন্তত পাওয়া যাবে নির্বাচনে। একই সাথে কার্য হাসিলও হবে ক্ষমতার থাকারও নিশ্চয়তা থাকবে। তাহলে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে বিএনপি কি তাহলে আন্দোলনের ফলাফল পাবে না?

‘৮৬ সালে সবার বেঈমানীর পরও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি যে দায়িত্ব পালন করেছিল সেই ভূমিকায় যেতে হবে এবার। তখনই ফলাফলের বিষয় সামনে আসনে বলে মনে করা হচ্ছে। মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন,’ বিএনপিকে আগে রাজপথে জিততে হবে’। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে এ আওয়ামী লীগ নেতার কথা ধরেই বিএনপিকে এগিয়ে যেতে হবে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনে। এদিকে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ডঃ আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, ‘বিএনপির অংশ গ্রহন ছাড়া দেশে কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হবে না।’ কথাটা একেবারে গুরুত্বহীন নয়। এ কথার গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যা করলে এই ইসি ও এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিবে না বিএনপি। বিষয়টি কি খুব সহজ? মোটেই না। তবে কয়েকদিন ধরে বিএনপির সমাবেশে গণমানুষের অংশগ্রহন কিন্তু আশাবাদী করছে তাদের। তবে রাজনীতি মাঠে থাকলে অন্দরমহলের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত অনেক কিছুই থাকবে না। কিন্তু যারা আন্ডারগ্রাউন্ড বোঝাপড়ার রাজনীতি করতে চায় তারাই এখন সবচেয়ে বেশী সরব। মনে রাখতে হবে সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হাতে সময় খুব কম। সব ফয়সালা এর মাঝেই করতে হবে। যারা দেশে- বিদেশে মিটিং সভা করছেন বলে শোনা যায় তাদের গন্তব্য কি তাও কিন্তু পরিষ্কার নয়। সুতরাং সামনে রাজনীতি আরো জটিল থেকে জটিলতর হবে বলে সবাই বলাবলি করছে। দেখা শেষ কি?
▪️ মাহমুদ হাসান, সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

[লেখাটি তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া]

Print Friendly, PDF & Email