৬ বছরেও শেষ হয়নি অপেক্ষার পালা

mde

অলিউল্লাহ নোমান |♦|

জীবন থেকে ৬টি বছর কেটে গেল দেখতে দেখতে। মনে হচ্ছে এই তো সে দিন পেনড্রাইভে করে স্কাইপ স্ক্যান্ডালের কথোপকথন নিয়ে চরম উত্তেজনা ছিলাম। কবে প্রকাশ হবে এ নিয়ে ছিল যত উত্তেজনা! দিন-রাত কম্পিউটারে বসে প্যানড্রাইভ থেকে নিজামুল হক নাসিম ও আহমদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথন শুনছি, আর লিখছি। সব রেডি। মাঝে মধ্যে ভয়ও পাচ্ছি। প্রকাশের আগেই যতি সরকার জেনে যায়! তাইলে তো আমার খবর আছে। প্রকাশ হবে কবে? নভেম্বর থেকেই সেই অপেক্ষা। কিন্তু টেকনিক্যাল কিছু বিষয় ছিল। এনিয়ে ছিল কিছুটা অনিশ্চয়তাও। শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল প্রকাশ করা হবে! অপেক্ষা একটি গ্রীন সিগন্যালের। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একাধিক দিন ঠিক করেছি প্রকাশের জন্য। কিন্তু শেষ মূহুর্তে এসে স্থগিত রাখতে হয়। প্রকাশের জন্য চুড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় সম্পাদক ছাড়া আর কেউ বিষয়টি জানেন না। জানার কথাও নয়। যতটা সম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করে চলছি শ্রদ্ধেয় সম্পাদক এবং আমি। নিউজ নিয়ে সম্পাদক মহোদয়কে দেয়ার পর প্রায় ৩ মাস শুধু আমার দু’জের মধ্যে এনিয়ে আলোচনা হয়। ৮ (২০১২) ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার পর গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেল। সম্পাদক মহোদয় বার্তা সম্পাদককে জানিয়ে দিলেন আজ একটি বিশেষ নিউজ যাবে। লিড নিউজ হিসাবে সেটার জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখার জন্য বলা হল। তখনো কেউ জানেন না সেই বিশেষ নিউজটা কি!
রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমার কম্পিউটার থেকে সার্ভারে প্রথম বার্তা বিভাগে ট্রান্সপার করলাম। সম্পাদক মহোদয় নিজেই অ্যাডিট করে দিয়েছিলেন। শিরোনাম ঠিক করা ছিল আগে থেকে-‘গভর্ণমেন্ট গেছে পাগল হইয়া তারা একটা রায় চায়’। এটা ছিল নিজামুল হক নাসিমের কথা। তিনি আহমদ জিয়াউদ্দিনকে এটা বলেছিলেন। এ উক্তিটি শিরোনামের জন্য নির্ধারিত করা হয় সম্পাদকের পক্ষ থেকে।
প্রথম নিউজটি প্রকাশের পর চরম উত্তেজনা। রাতে আর বাসায় ফিরিনি। অফিসেই থেকে গেলাম। সকালে বাসায় ফিরলাম। দুপুরে প্রেসক্লাবে গেলাম। সবার মাঝে এ নিউজ নিয়ে আলোচনা। সারা দেশে সকাল ১০টায় পত্রিকা শেষ। কোথায়ও আমার দেশ পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা গেছে এক কপি পত্রিকা সেদিন ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন হকাররা।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সম্পাদক মহোদয় ফোন করলেন। জানালেন, শুধু এ নিউজটি দিয়ে একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করা হবে আজই। সারা দেশ থেকে চাহিদা আসছে। দ্রুত অফিসে চলে গেলাম। বিশেষ বুলেটিন রেডি করে দিলাম। ছাপা হয়ে বাজারেও চলে গেল বিকাল ৪টার মধ্যে। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটাই হয়ত: প্রথম ঘটনা-কোন একটি বিশেষ নিউজ নিয়ে পাঠকের চাহিদ পুরনের জন্য বুলেটিন বের করা। নিউজটির রিপোর্টার হিসাবে আমার সেদিন উত্তেজনা বাড়ারই কথা। যে কারো এমনটা হবে। এখানে উল্লেখ্য, বুলেটিন আরো হয়েছে, ঘটনা ঘটে গেলে সেটা পাঠকের কাছে দ্রুত পৌছে দেয়ার নিমিত্তে। কিন্তু একটি বিশেষ নিউজ প্রকাশ হয়েছে। পত্রিকা সকাল ১০টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে গেছে। বাজারে চাহিদা অনেক। তাই ওইদিনই আবার সেই নিউজ দিয়ে বিশেষ বুলেটিন বের করার ঘটনা বিরল বলা চলে।
একে একে সিরিজ চলতে থাকল। ৯ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কাইপ স্ক্যান্ডাল প্রকাশ হল ধারাবাহিক। ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হল। স্কাইপ কথোপকথর প্রকাশ করা যাবে না। সঙ্গে আমার দেশ পত্রিকার প্রতি রুল জারি করা হল। সে রাতেই ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে গিয়ে মামলা করলেন। আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা হল। সম্পাদক মহোদয় অফিসে বন্দি হয়ে পড়লেন। এর মাঝে নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করে ট্রাইব্যুনাল ছাড়লেন।
মামলা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ১৭ ডিসেম্বর দুপুর গড়িয়ে বিকাল ৩টা। হঠাৎ করেই সম্পাদক মহোদয় রুমে ডাকলেন আমাকে। তাঁর চেহারায় উদ্বেগের চাপ স্পষ্ট। এ ঘন্টাখানেক আগেও তাঁর সাথে মিটিং হয়েছে। এতটা উদ্বেগ দেখিনি। জানতে চাইলেন, আমার পাসপোর্টে কোন দেশে ভিসা লাগানো আছে কিনা! বললাম, আছে। ইউকে’র ভিসা আছে পাসপোর্টে। তবে মেয়াদ খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। এর আগে জুলাই মাসে ইউকে সফর করতে হয়েছিল আরেকটি বিশেষ নিউজের তথ্য সংগ্রহের জন্য। মনে করলাম হয়ত: এরকম কিছু একটা হবে। পাল্টা জিজ্ঞেস কলাম জরুরী কোন বিষয় আছে? উত্তরে তিনি বললেন, জরুরী ভিত্তিতে তোমাকে লন্ডন যেতে হবে। তুমি আগে যাও। তারপর বলব, সেখানে তোমাকে কি করতে হবে। বললাম কখন যেতে হবে? আজই যেতে হবে, জানালেন তিনি। সঙ্গে এটাও বললেন, আর কাউকেই জানানো যাবে না বিষয়টি। শুধু আমারা দুইজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। এটা শোনার পর অস্থিরতা বাড়তে থাকল আমার। তিনি বললেন, এখনই বাসা থেকে পাসপোর্টটা নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর। টিকেটের ব্যবস্থা হচ্ছে।
একটু পরই জানালেন, টিকেট পাওয়া গেছে। রাত ৯টায় এমিরাটস এয়ার লাইন্সে ফ্লাইট। সঙ্গে সঙ্গে চোখের পানি ফেলে দিয়ে বললাম, কাল গেলে হয় না! একদিন পর যাই। তিনি বললেন, না। আজই যাও। গেলে পর বুঝবে কেন তোমাকে আজই যেতে বলছি।
এভাবেই ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিকালে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা রেখে অফিস থেকে বের হয়েছিলাম।
অফিসের একটি গাড়ি তখন আমার ব্যবহারের জন্য ছিল। ড্রাইভার কাশেমকে ডাকলাম। গাড়ি রেডি করতে বললাম। কাশেমকে নিয়ে প্রথমে বাসায় যাই। বাসায় মিনিট কয়েক ছিলাম। ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসি। স্ত্রীকে শুধু বললাম, লন্ডনে যাচ্ছি জরুরী কাজে। শুনে বললেন, হঠাৎ করে লন্ডনে কেন! আগে তো কিছু জানালে না। জানতে চাইলো, কখন ফিরব। বললাম, এখনো জানি না। যাওয়ার পর বলা যাবে। এরকম দু/একটি কথা বলে দ্রæত বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
কাশেম তখনো জানে না পরবর্তী যাত্রা কোন দিকে। গাড়িতে ব্যাগ উঠানোর পর কাশেম জিজ্ঞেস করে, অফিসে যাব স্যার? না। এয়ারপোর্টের দিকে চল। পথে এক জায়গায় টিকেট নিয়ে আরেকজন অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর নিকট থেকে টিকেট সংগ্রহ করলাম। গাড়ি এয়ারপোর্টে দিকে রওয়ানা দিল।
এয়ারপোর্টে পৌছার পর কাশেম জিজ্ঞেস করে, স্যার আমি কি বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষ করব? পকেট থেকে ১ হাজার টাকা বের করে তাঁকে দিয়ে বললাম, গাড়ি নিয়ে অফিসে চলে যাও। আমি ফোন দিলে আবার এসে নিয়ে যেও।
এমন একটি অনিশ্চিত জীবনের পথে রওয়ানা দেয়ার পর ৬ বছর গত হয়েছে আজ। এই ৬ বছর ধরেই শুধু অপেক্ষায় আছি, কবে ফিরব নিজের মাতৃভুমিতে।

Print Friendly, PDF & Email